
ছবি: সংগৃহীত
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা চাপ ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক মন্দার ছায়া, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রাজস্ব সংগ্রহে ধীরগতি—সব মিলিয়ে এক ধরনের বহুমাত্রিক সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরার কিছুটা আভাস মিললেও, বাস্তবতা আরও জটিল হয়েছে। এরই মধ্যে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘিরে সরকার যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি, তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এক প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয় জানায়, নতুন বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আটটি বড় চ্যালেঞ্জ গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে:
১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
২. খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা
৩. দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান
৪. সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বিস্তৃতি
৫. রাজস্ব আয়ের সম্প্রসারণ
৬. বিনিয়োগ ও বাণিজ্য পরিবেশের উন্নয়ন
৭. এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি
৮. শিল্প খাতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো
অর্থনীতিতে বহুমুখী চাপ: চিহ্নিত চ্যালেঞ্জের বিস্তারিত
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের ওঠানামা এবং টাকার অবমূল্যায়ন এর মূল কারণ। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণে অনেক পণ্য আমদানিতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, যা শিল্প উৎপাদন ব্যাহত করছে।
বিশেষ করে পোশাক খাত, রপ্তানিনির্ভর অন্যান্য শিল্প এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কাঁচামালের সংকটে পড়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কিছু এলাকায় শ্রমিকদের আন্দোলন ও কারখানা বন্ধের ঘটনাও ঘটেছে। এতে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে।
বিনিয়োগে ধস: থমকে আছে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মানে, নতুন বিনিয়োগ কার্যক্রম খুবই সীমিত। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তিও কমেছে ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা এক বছরে বেড়েছে প্রায় সোয়া ৩ লাখ। বর্তমানে বেকার মানুষের সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ঝুঁকি বাড়বে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক লিড ইকোনমিস্ট (বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস) ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে আয় বাড়বে না। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাবে, যা অর্থনীতির সামগ্রিক গতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বাজেটে এসব বিষয় অগ্রাধিকার না পেলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে।”
রাজস্ব ঘাটতি ও ঋণনির্ভর বাজেট
আসন্ন বাজেটে সরকারের রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আসবে এনবিআর থেকে। অথচ চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে এনবিআরের রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “প্রতিবছর বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকে। রাজস্ব আয় যেমন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না, তেমনি প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা স্পষ্ট। বাজেটে ব্যয় বাড়ানোর আগে কর্মদক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।”
নতুন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র সুদ পরিশোধেই বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা—যা মোট বাজেট ব্যয়ের প্রায় ১৭ শতাংশ।
বাজেটের আকার ও কাঠামো
২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের মোট আকার ধরা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা অনুন্নয়ন ব্যয় হবে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং উন্নয়ন বাজেট ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
তবে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা কমিয়ে নতুন বাজেটে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তায় জোর, কিন্তু যথেষ্ট নয়
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরম বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ৮টি ভাতাভুক্ত কর্মসূচিতে উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতা পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “রাজস্ব আহরণে গতি আনতে হবে। তবে করের হার না বাড়িয়ে করের ভিত্তি বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো না হলে বৈষম্য বাড়বে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পথ সুগম করতে হবে।”
এলডিসি উত্তরণ ও রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার ঝুঁকি
বাংলাদেশ ২০২6 সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠবে। এতে কিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধা হারাতে হবে। সেই প্রস্তুতির জন্য প্রণোদনা নীতি, কর কাঠামো এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
সামনে অর্থনীতির পথ অনেকটাই কণ্টকাকীর্ণ। রাজস্ব ঘাটতি, ঋণ নির্ভরতা, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা—সব মিলিয়ে আসন্ন বাজেটের প্রণয়ন একটি কঠিন পরীক্ষা। সরকারকে একদিকে জনগণের চাহিদা পূরণ করতে হবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ভারসাম্যও রক্ষা করতে হবে। বাজেটের আকার যতই হোক, তার বাস্তবায়নযোগ্যতা ও আর্থসামাজিক প্রভাব হবে আসল প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ