
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিন ধরে মধ্যবিত্ত ও নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাছে সঞ্চয়পত্র ছিল সঞ্চয়ের অন্যতম নিরাপদ মাধ্যম। সরকারের নির্ধারিত সুদের হারে বিনিয়োগকারীরা পেতেন নিশ্চিত আয়, যার ওপর ভিত্তি করেই অনেক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, গৃহিণী বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতে সুদের হার বৃদ্ধি, ট্রেজারি বন্ড ও স্বর্ণে বিনিয়োগে নতুন আগ্রহসহ একাধিক কারণে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
সঞ্চয়পত্রে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি, সরকারকেই পরিশোধ করতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার। তবে একই সময়ের মধ্যে সঞ্চয়পত্র ভেঙে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার, অর্থাৎ সরকারকে ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা বাড়তি পরিশোধ করতে হয়েছে। এ প্রবণতা শুধু চলতি অর্থবছরেই নয়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও একই চিত্র দেখা গেছে, যেখানে পুরো বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাবদ আদায়ের তুলনায় ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে সরকার।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের লক্ষ্য ছিল চলতি অর্থবছরে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি, অথচ বছর প্রায় শেষের পথে এসেও এর অর্ধেকেরও কম বিক্রি হয়েছে। ফলে সরকারও এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এনেছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটিতে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে এখান থেকে সরকার এক টাকাও ঋণ নিতে পারেনি।
মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাতের সুদহার: বড় কারণ
বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে উঠেছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে, আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে নাগরিকরা বাধ্য হচ্ছেন পূর্বে কেনা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে সংসার চালাতে, ছেলে-মেয়েদের বিদেশ পাঠাতে, কিংবা জরুরি খরচ মেটাতে। বাংলাদেশের মতিঝিল অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, “মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে।”
এছাড়া ব্যাংক ও ট্রেজারি বন্ডে বর্তমানে যে সুদহার পাওয়া যাচ্ছে, তা সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশি। অনেক ব্যাংকে এখন ১০ শতাংশ বা তারও বেশি সুদহার পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলে মুনাফা ১১.৬০ শতাংশ। ফলে ঝুঁকিমুক্ত ও সহজলভ্যতার কারণে অনেকেই এখন ব্যাংক বা বন্ডে বিনিয়োগ করছেন।
বিনিয়োগকারীদের মতামত: ব্যাংকে আস্থা, স্বর্ণে আগ্রহ
ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার ঘটনা এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে দেখা যায়, সঞ্জীব ও তার স্ত্রী সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে এসেছেন। সঞ্জীব বলেন, “মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর আমরা আর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবো না। ব্যাংকেই এখন ভালো মুনাফা দিচ্ছে, ঝুঁকিও কম। সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী আমরা।”
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হাসানুর রহমান বলেন, “আগে সঞ্চয়পত্রেই বিনিয়োগ করতাম। কিন্তু এখন দেখি ব্যাংক ও ট্রেজারি বন্ডে বেশি লাভ। আমি বন্ডে যেতে চাই। তবে স্ত্রীরটা এখনো সঞ্চয়পত্রেই রেখেছি।”
আবার এক শ্রেণির মানুষ সঞ্চয়পত্রের টাকা তুলে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছে। হাসিনা বানু লাবণী বলেন, “আমি ব্যবসা করতে পারবো না। তাই ভাবছি গহনা তৈরি করে স্বর্ণে বিনিয়োগ করবো। দাম বাড়ছে, ভবিষ্যতে নাতি-নাতনির বিয়েতেও লাগবে।”
ব্যাংক ও বন্ডে আস্থা বৃদ্ধির বাস্তবতা
সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, “বর্তমানে ব্যাংক ও বন্ডে ভালো রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে। মানুষ আগের মত ব্যাংকের প্রতি ভীতি নিয়ে নেই। প্রায় সব ব্যাংকই এখন ১০ শতাংশ হারে মুনাফা দিচ্ছে। অনেকেই এখন সঞ্চয়পত্রের ঝামেলা না নিয়ে এইসব সহজলভ্য মাধ্যমেই বিনিয়োগ করছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে কিছু জটিলতা থাকলেও ব্যাংকে যেকোনো সময় টাকা তোলা যায়। আবার ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করলে বেটিংয়ের মাধ্যমে লাভের অংশ পাওয়া যায়। ফলে অনেকে এখন ব্যাংকের মাধ্যমে বন্ডে যাচ্ছেন। এছাড়া স্বর্ণের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেটাও এখন বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে।”
অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ: সঞ্চয়পত্রে সরকারি নির্ভরতা হ্রাস দরকার
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সঞ্চয় আহরণ আসলে সরকারের জন্য ঋণ সৃষ্টি করে। এর ওপর যদি উচ্চ সুদের হার থাকে, তাহলে সেটা সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হয়।”
তিনি বলেন, “দীর্ঘমেয়াদে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা ভালো পন্থা নয়। বরং ক্যাপিটাল মার্কেটকে শক্তিশালী করে জনগণের সঞ্চয়কে সেখানে আকৃষ্ট করা উচিত। এছাড়া বেসরকারি খাতে ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয় প্রবাহিত করলে তা উৎপাদনশীল বিনিয়োগে পরিণত হতে পারে।”
নীতিনির্ধারকদের করণীয়: বিকল্প বিনিয়োগ ও রিফর্ম
এই প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় করা, কেনার ও ভাঙানোর প্রক্রিয়া সহজ করা এবং বিকল্প বিনিয়োগ মাধ্যমকে উৎসাহ দেওয়া। অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়পত্র শুধু সরকারের রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নয়, বরং একটি পরিমিত মাত্রায় ব্যবহারের মাধ্যম হতে হবে।
একইসঙ্গে ট্রেজারি বন্ড, রপ্তানি বন্ড, ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড, ক্যাপিটাল মার্কেট, কিংবা রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (REIT)-এর মতো বিকল্প ও উৎপাদনশীল বিনিয়োগমুখী ব্যবস্থা চালু ও জনপ্রিয় করতে হবে। তবেই ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও রাষ্ট্রীয় দায়—দুটোর মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে বেশি সুদ, স্বর্ণে বাড়তি লাভ এবং বন্ডে বিনিয়োগের সহজলভ্যতার কারণে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহ কমছে। অনেকেই মেয়াদ শেষে আর বিনিয়োগ করছেন না, বরং সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন বা লাভজনক অন্যান্য মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করছেন। এর ফলে সরকারকে বিক্রির তুলনায় বেশি অর্থ ফেরত দিতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প বিনিয়োগ ও রাজস্ব সংগ্রহের রূপান্তর দরকার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ