
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছে একাধিক মৌলিক দাবির মধ্য দিয়ে। ‘জুলাই ঘোষণা’, ‘জুলাই সনদ’, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং গণপরিষদ নির্বাচন—এই চারটি বিষয়কে সামনে রেখে এনসিপি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক রূপরেখা দাঁড় করানোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সোমবার রাতেই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে তিনি এসব বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরেন। যদিও পোস্টে তিনি এসব দাবির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি, তবে তার আগের ও পরের দিনগুলোর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দলটির রাজনৈতিক দর্শন ও ভবিষ্যৎ কৌশলের খসড়া চিত্র স্পষ্ট হয়।
নাহিদ ইসলাম তার পোস্টে এনসিপির সাতটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করেন, যা দলের রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তার মতে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম ভিত্তি হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তিনি বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদার আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেই এনসিপির পথচলা।" একইসঙ্গে হিন্দু-মুসলমান-দলিত জনগোষ্ঠীর উপনিবেশ ও ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকেও নিজেদের রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
ধর্ম বিষয়ক অবস্থান স্পষ্ট করে নাহিদ ইসলাম বলেন, এনসিপি কোনো সেকুলারিস্ট বা ধর্মতান্ত্রিক মতবাদের অনুসারী নয়। বরং তারা নাগরিকদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলতে চায়। ইসলামের নৈতিকতা ও বাঙালি মুসলমানের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার প্রতি সম্মান দেখানোর পাশাপাশি সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে এনসিপির ঘোষণায়।
নারীর অধিকার ইস্যুতেও এনসিপি নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেছে। নাহিদ ইসলাম বলেন, "পারিবারিক আইনের আওতায় সম্পত্তিতে নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ে এনসিপি কাজ করবে।" এর পাশাপাশি নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, নেতৃত্ব ও কর্মসংস্থানের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নকে দলের অন্যতম মূলনীতি হিসেবেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদ বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক হুমকি। এনসিপি এ ধরনের প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর রাজনৈতিক অবস্থান নেবে বলে জানান তিনি। রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে মর্যাদা, সভ্যতা ও জাতীয় স্বার্থকে ভিত্তি করে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি।
অর্থনৈতিক দর্শনে এনসিপি একটি ‘ইনসাফভিত্তিক দূর্নীতিমুক্ত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন, নগর ব্যবস্থাপনা, শ্রম অধিকার ও কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের নকশা প্রস্তাব করছে দলটি। একইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে একটি নতুন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোন গঠনের ভিশনও প্রকাশ করেছেন নাহিদ ইসলাম।
সবশেষে দলের মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম বলেন, “ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করা এনসিপির প্রধান কর্তব্য।” এর জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পুনর্গঠন, প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর মতে, এই তিনটি পদক্ষেপই একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের পূর্বশর্ত।
‘জুলাই ঘোষণা’ ও ‘জুলাই সনদ’ নামে যেসব ধারণা নাহিদ ইসলাম তুলে ধরেছেন, সেগুলোর ব্যাখ্যা না দিলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি হতে পারে এনসিপির পক্ষ থেকে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের রূপরেখা বা রাজনৈতিক চুক্তির প্রস্তাব, যার মাধ্যমে তারা নতুন নির্বাচনী কাঠামো ও ক্ষমতা বণ্টনের দাবি উত্থাপন করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখাও একধরনের বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার সূচক হতে পারে।
একদিকে যখন দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সাংবিধানিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির মতো একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি নিজস্ব দর্শন, দাবি ও প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ, সাম্য, ধর্মীয় সহাবস্থান, নারীর অধিকার, আঞ্চলিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা এবং নতুন সংবিধানের দাবি—সবমিলিয়ে এনসিপির এই আত্মপ্রকাশ এক ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক পথের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, দলটি মাঠের রাজনীতিতে কীভাবে নিজেদের জায়গা করে নেয় এবং জুলাই সনদের মতো ধারণাগুলো বাস্তবে কী রূপ ধারণ করে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ