
ছবি: সংগৃহীত
উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টি, দমকা হাওয়া ও উত্তাল সমুদ্র পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এলাকায় টানা দুদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, কোথাও কোথাও তা মাঝারি আবার কোথাও ভারী মাত্রায় নেমে এসেছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে পর্যটননির্ভর এই জনপদ এখন কার্যত পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে।
বুধবার (২৯ মে) সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘন মেঘে ঢাকা আকাশ এবং সময় সময় গর্জে ওঠা আকাশের শব্দ উপকূলবাসীর মাঝে এক ধরনের অজানা শঙ্কা তৈরি করেছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই আলো কম থাকায় অনেক এলাকাতে বিদ্যুৎ সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
লঘুচাপের প্রভাবে সমুদ্রের পানির স্তর স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কয়েক ফুট বেড়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহআলম বলেন, “লঘুচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি নদ-নদীতে ঢুকে পড়েছে এবং পানি বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিছু এলাকায় নিচু চরাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে এবং ভাঙনকবলিত বেড়িবাঁধগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, “পাউবোর পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং স্থানীয়দের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যদি পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়, তবে জরুরি মেরামতের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।”
উপকূলের অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ বহুদিন ধরেই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অতিরিক্ত জোয়ারের চাপে এসব বাঁধ যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কুয়াকাটা সংলগ্ন আলীপুর, মহিপুর, লতাচাপলী, ধুলাসার, বালিয়াতলীসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগে থেকে মেরামত না করায় এখন ভাঙনের শঙ্কা বেড়ে গেছে।
আলীপুরের জেলে শহিদুল ইসলাম বলেন, “এই সময়টাতে আমরা মাছ ধরতে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু এখন নৌকা নিয়ে সাগরে নামার সাহস পাচ্ছি না। সাগরের এমন অবস্থা আগে দেখিনি, একেবারে টালমাটাল। আমাদের সবচেয়ে বেশি ভয় বাঁধটা নিয়ে—ওটা ভাঙলে অনেক ক্ষতি হবে।”
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্পট কুয়াকাটায় এখন পর্যটকশূন্য অবস্থা। দুই দিন ধরে বৃষ্টি, দমকা হাওয়া এবং আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবার্তার কারণে আগত পর্যটকরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন এবং নতুন কেউ আসছেন না। হোটেল-মোটেল মালিকরা জানিয়েছেন, হঠাৎ করে পর্যটক না থাকায় ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনির হোসেন বলেন, “আগামী মাসে ঈদকে সামনে রেখে বুকিং নেওয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু আবহাওয়ার এই অস্থিরতা এবং লঘুচাপের কারণে অনেকেই বুকিং বাতিল করছেন। পর্যটন কেন্দ্রের পরিবেশ এখন শুনশান, যা এই মৌসুমে একেবারে অস্বাভাবিক।”
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থানরত লঘুচাপটি আরও ঘনীভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া এবং ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
পায়রা, মোংলা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। মাছ ধরার ট্রলার ও ছোট নৌযানগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গভীর সাগরে না গিয়ে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “লঘুচাপটি যদি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়, তাহলে সাগর আরও বেশি উত্তাল হয়ে উঠবে এবং ঝড়ো বাতাসের গতি বাড়বে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে আরও বেশি বৃষ্টি এবং জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।”
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি সক্রিয় রয়েছে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে স্থানীয় স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খোলা হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ত্রাণসামগ্রী।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমরা সার্বক্ষণিক আবহাওয়া বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণ, বাঁধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং জনগণকে সচেতন করার কাজ চলছে।”
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ এখন উপকূলীয় জনপদের জন্য এক ধরনের পরীক্ষার সময় নিয়ে এসেছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, বাঁধ ভাঙনের শঙ্কা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি—সব মিলিয়ে কুয়াকাটা ও আশপাশের এলাকার মানুষজন চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে চলতে হবে, একইসঙ্গে উপকূলবাসীকেও থাকতে হবে সতর্ক এবং সচেতন।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপই পারে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ