
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি পর্যায়ে ঘোষিত সংস্কার পরিকল্পনার বাস্তবায়নে গতি নেই—এমন চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ঘোষিত ১২১টি ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ সংস্কার প্রস্তাবের অগ্রগতিতে। গত ১৩ মার্চ এসব সুপারিশ চিহ্নিত করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও তার কার্যকর বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, দেরি শুধু রাজনৈতিক অনিচ্ছা নয়—প্রক্রিয়াগত জটিলতা, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা সংস্কারের গতি থমকে দিয়েছে।
প্রক্রিয়া থেমে আছে মূল্যায়নেই
২৩ মে উপদেষ্টা পরিষদের সর্বশেষ বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা যেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করে জানায়—এই সুপারিশগুলো আদৌ কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, কতটা সময় লাগবে বাস্তবায়নে এবং এসব সংস্কারের সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে। অথচ এমন নির্দেশনা আসতে আড়াই মাস সময় লেগে গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, “আমরা এখন সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে পর্যালোচনার কাজ শুরু করব। তারপর উপদেষ্টা পরিষদে সেগুলো উপস্থাপন করা হবে। তবে কাজটি কখন শেষ হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।” তিনি আরও জানান, “যেসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ছাড়াই বাস্তবায়নযোগ্য, সে বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা কাজ করছি।”
নির্বাচনী সংস্কারও ঝুলে গেছে
১২১টি সংস্কারের মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত প্রস্তাব ছিল ৯টি, যা নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত রেখেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এগুলো মূলত আইন সংশোধন ও নীতিমালা প্রণয়নের বিষয় হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এককভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এরপর থেকে আইন মন্ত্রণালয় কিংবা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া পাইনি। আমরা আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি না।”
বিশ্লেষক ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমরা আরপিওসহ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাদেশগুলোর খসড়া জমা দিয়েছি। এগুলো অনেক আগেই বাস্তবায়নযোগ্য ছিল। বিলম্ব হচ্ছে কেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। সংস্কার নিয়ে যে জাতীয় আলোচনা চলছে, সেখানে অন্তত বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবগুলো তো আর আটকে রাখার সুযোগ নেই।"
বিচার ও প্রশাসন সংস্কারেও অচলাবস্থা
বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের দেওয়া ৩৮টি সুপারিশেরও অগ্রগতি তেমন নেই। বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় গঠনের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানানো হলেও তা বাস্তবে আলোর মুখ দেখছে না।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন, “পৃথক সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত অনেক আগেই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। এরপরও তা কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না, আমরা জানি না। বিচার-সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়ন ঝুলে থাকলে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মতামত পাওয়া যায়নি। তিনি খুদেবার্তার জবাবও দেননি।
প্রশাসন বলছে: বাস্তবায়ন সম্ভব, রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার
একাধিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক সংস্কার এমন রয়েছে যেগুলো অধ্যাদেশ জারি করেই দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব। নির্বাচন, দুদক এবং প্রশাসনসংক্রান্ত সুপারিশের অনেকগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে রূপান্তরযোগ্য। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর এসব অধ্যাদেশ মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনে বাস্তবায়ন করা যেত।
প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. সামসুল আলম বলেন, “১২১ সুপারিশের মধ্যে অন্তত ৬০-৭০টি এমন রয়েছে যেগুলোর জন্য সংসদীয় প্রক্রিয়া লাগবে না। কিন্তু সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সংকোচ বা সিদ্ধান্তহীনতা থাকলে প্রশাসন একা এগোতে পারবে না।”
জাতীয় ঐকমত্যে গতি, কিন্তু তফাৎ সুস্পষ্ট
অন্যদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রথম দফার আলোচনা শেষ করেছে। দ্বিতীয় দফার আলোচনারও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে বিভিন্ন দলের মধ্যে মৌলিক প্রশ্নে মতানৈক্য থাকায় দ্রুত ঐকমত্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদের ক্ষমতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দলীয় প্রধানের ক্ষমতা সীমিত করার প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সরকার যেসব প্রস্তাব দলীয় মতামত ছাড়াই বাস্তবায়ন করতে চায়, সেগুলো বিলম্বিত হলে মানুষ সংস্কারের প্রতি আস্থা হারাবে। একদিকে সংস্কারের ডাক, আরেকদিকে কার্যকর অগ্রগতির অভাব—এটা সরকারের ভাবমূর্তির জন্যও অশনিসংকেত।”
ইতিবাচক ব্যতিক্রম কিছু
যদিও ১২১ সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে অগ্রগতি নেই বললেই চলে, এর আগেই অন্তর্বর্তী সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ (২০ নভেম্বর, ২০২৪ ও ১০ মে, ২০২৫), বিচারক নিয়োগে স্বতন্ত্র কাউন্সিলের বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি (২১ জানুয়ারি, ২০২৫), পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত (১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) এবং সর্বশেষ ১৩ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব ব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করা।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও তা মূলধারার ১২১ সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেগুলোর জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি ছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন এখনো শুরুই হয়নি।
সময়ের দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন
দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচনকালীন সময় ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে সরকার ঘোষিত সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়নে গতি না থাকলে তা জাতীয় সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। নির্বাচন, বিচার, পুলিশ, দুদক ও প্রশাসন—এই পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার শুধু সরকারের ভাবমূর্তি নয়, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গণতন্ত্র ও উন্নয়নের দোহাই দিয়ে দেওয়া সংস্কার প্রতিশ্রুতি যদি নথিপত্রেই পড়ে থাকে, তবে তা সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এখন দেখার বিষয়, উপদেষ্টা পরিষদ নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা দ্রুততা দেখাতে পারে—নাকি আলোচনা আর ফাইলে ঘোরাফেরার মধ্যেই সংস্কারের স্বপ্ন থেমে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ