
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের ফলে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা শুধু ভবন, সড়ক, অবকাঠামো বা হাসপাতাল ধ্বংস করে থেমে নেই—এই যুদ্ধ প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের শৈশব, জীবন, স্বপ্ন। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ শুক্রবার এক্স (সাবেক টুইটার) এ দেওয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় প্রতি ২০ মিনিটে অন্তত একটি শিশু নিহত হয়েছে। তাত্ত্বিক হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত নিহত বা আহত শিশুদের সংখ্যা ৫০,০০০ ছাড়িয়েছে।
ইউনিসেফের ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “প্রতি ২০ মিনিটে এক শিশুর মৃত্যু মানে শুধুই পরিসংখ্যান নয়, বরং সেটি একটি শৈশব, একটি জীবন, একটি পরিবারের আশা-ভরসা, ভালোবাসা এবং ভবিষ্যতের চূড়ান্ত বিনাশ।” সংস্থাটি বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে শিশুদের ওপর এমন নিষ্ঠুর হামলা, তাদের হত্যা কিংবা গুরুতরভাবে আহত করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন। যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও বাস্তবে গাজায় তাদের রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থাই নেই।
গাজায় মানবিক সংকটের চিত্র ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। গুলি, বোমা, ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তা যেন প্রতিদিনের বাস্তবতা। শুক্রবারও গাজার একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ক্ষুধার্ত মানুষের লাইনে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। আল-জাজিরার বরাত দিয়ে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’-এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বেসামরিক মানুষ লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালায়। গাজার হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, আহতদের বেশিরভাগই ছিলেন ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে নারী ও শিশু ছিল উল্লেখযোগ্য।
গাজায় দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ পরিস্থিতি এবং লাগাতার হামলার ফলে খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) শুক্রবার সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজার শতভাগ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের হাতে বর্তমানে দুই লাখের বেশি মানুষের জন্য এক মাসের খাবার, ময়দা, শুকনো রেশন, স্বাস্থ্য উপকরণ, কম্বল এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুত রয়েছে। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়। কারণ গাজার অবরুদ্ধ এলাকায় প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ছেন।
শুক্রবারের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় সেদিন গাজায় আরও ২৮ জন নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব তথ্য জানিয়ে বলেছে, আহতদের অনেকেই সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে ওষুধ, ব্যান্ডেজ এমনকি অক্সিজেন পর্যন্ত ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক চিকিৎসাকেন্দ্র কার্যত ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও দেওয়া যাচ্ছে না।
যুদ্ধ শুধু সামরিক বাহিনীর বিষয় নয়—যখন তা জনবহুল আবাসিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবচেয়ে বড় বিপদে পড়ে শিশুরা। জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, রেড ক্রসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও শিশুদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দীর্ঘদিনের অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা, এবং পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রবেশে বাধার কারণে শিশুরা সেখানে এখন চরম অপুষ্টি, মানসিক আঘাত এবং স্থায়ী শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
ইউনিসেফ, ইউএনআরডব্লিউএ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার গাজার জন্য মানবিক করিডোর খুলে দেওয়ার আহ্বান জানালেও কার্যত ইসরায়েলের অবস্থান অপরিবর্তিত। একদিকে সামরিক অভিযান, অন্যদিকে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা বন্ধ রেখে তাদের অভিযানকে কার্যত একটি ‘মানবিক যুদ্ধ’ হিসেবে পরিণত করা হয়েছে বলে সমালোচনা করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে প্রশ্ন এখন একটাই—গাজায় শিশুদের জীবন এতটা মূল্যহীন কেন? কেন তাদের কান্না, তাদের ক্ষুধা, তাদের মৃত্যু বিশ্বের বিবেক নাড়া দেয় না?
এই মুহূর্তে বিশ্বের চোখ, কানের পাশাপাশি হৃদয়েরও দরকার আছে গাজার দিকে তাকানোর। কারণ, প্রতি ২০ মিনিটে এক শিশুর মৃত্যু মানে শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়—এটি একেকটি পরিবার, একেকটি জাতির ভবিষ্যতের মৃত্যু। সেই মৃত্যুর মিছিলে যদি থামার চেষ্টা না হয়, তবে মানব সভ্যতার ইতিহাস এক ভয়ঙ্কর কলঙ্কচিহ্ন বহন করেই সামনে এগোবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ