
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অভিযান, বেসামরিক হতাহতের ভয়াবহতা এবং আন্তর্জাতিক মহলের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রস্তাবের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়া দিয়েছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। তবে তাদের একমাত্র শর্ত—চুক্তিটি অবশ্যই একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির রূপ নেবে, যা এতদিন ধরে ইসরাইলের জন্য একটি কঠোর ‘রেড লাইন’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল।
গত শনিবার হামাস এক লিখিত বিবৃতিতে ঘোষণা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফের মাধ্যমে প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির রূপরেখার সঙ্গে সম্মত হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এই প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হলো গাজা উপত্যকায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির সূচনা, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং অবরুদ্ধ অঞ্চলের জনগণের জন্য অবাধ মানবিক সহায়তার পথ সুগম করা।
হামাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ১০ জন জীবিত জিম্মি এবং আরও ১৮টি মৃতদেহ ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত রয়েছে। এর বিনিময়ে ইসরাইলকেও একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি দিতে হবে। এই বিনিময়ের প্রক্রিয়া এবং বিবরণ উইটকফের প্রস্তাবের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে বলে বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়।
হামাস জানায়, তারা এই প্রস্তাবের বিষয়ে একটি ‘জাতীয় পরামর্শ প্রক্রিয়া’ সম্পন্ন করেছে, যাতে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংগঠনটির বক্তব্যে ছিল, ‘আমরা মনে করি, এই প্রস্তাবের লক্ষ্য হলো স্থায়ী যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে রক্তপাতের অবসান ঘটানো এবং গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা।’
যদিও হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, ইসরাইল এখনো তাৎক্ষণিক কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, চলতি সপ্তাহের শুরুতে নেতানিয়াহু গাজায় আটক জিম্মিদের পরিবারের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, তার সরকার উইটকফের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানায়, তারা হামাসের প্রতিক্রিয়া পেয়েছে এবং এটিকে একটি ‘গঠনমূলক অগ্রগতি’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
তবে রয়টার্সের কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হামাস কিছু ‘আংশিক সংশোধন’ চাইলেও তাদের প্রতিক্রিয়া মোটের ওপর ইতিবাচক। তার মতে, এই মুহূর্তে চুক্তির সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং এটি যুদ্ধের একটি কার্যকর ইতি টানতে পারে।
যদিও এই প্রস্তাবে অগ্রগতি হয়েছে, মূল দ্বন্দ্ব এখনো অনড় রয়েছে। ইসরাইল চায়, হামাস যেন পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়, তাদের সামরিক ও প্রশাসনিক কাঠামো বিলুপ্ত করে এবং অবশিষ্ট ৫৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়—এবং কেবল তখনই যুদ্ধ বন্ধ হবে।
অন্যদিকে, হামাস বলছে, তারা অস্ত্র ছাড়বে না এবং যুদ্ধ শেষ করতে হলে ইসরাইলকে অবশ্যই গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে, অবরোধ উঠাতে হবে এবং যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় দক্ষিণ ইসরাইলে প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার পরপরই ইসরাইল গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ৫৪,৪০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অসংখ্য শিশু, নারী ও বয়স্ক নাগরিকও এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন। গাজা উপত্যকার অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে—গির্জা, মসজিদ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
অতিরিক্তভাবে, মার্চ মাস থেকে গাজার ওপর পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল। এর ফলে খাদ্য, পানি, জ্বালানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্য প্রবেশ নিষিদ্ধ করে, যা অঞ্চলটিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
চলমান মানবিক সংকট ও ভয়াবহ প্রাণহানির মুখে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লিগসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্র উভয় পক্ষকে একটি চূড়ান্ত শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানোর আহ্বান জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান এই প্রস্তাবকে অনেকে একটি সম্ভাব্য ব্রেকথ্রু হিসেবে দেখছেন, যদিও চূড়ান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন এখনো বহু জটিল শর্তের ওপর নির্ভর করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি ইসরাইল স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়, তবে এটি গাজার জন্য একটি দীর্ঘদিনের যুদ্ধাবসানের সূচনা হতে পারে। অন্যদিকে, ইসরাইল যদি তার পূর্ববর্তী অবস্থানেই অনড় থাকে, তবে চূড়ান্ত চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
এই প্রেক্ষাপটে, হামাসের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রস্তাবে শর্তসাপেক্ষ সম্মতি ভবিষ্যতের কূটনৈতিক ও সামরিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেন্দ্রীভূত হয়েছে ইসরাইলের ওপর—তারা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে কতটা বাস্তব সম্মত ও মানবিক সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই নির্ধারণ করবে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পরবর্তী গন্তব্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ