
ছবি: সংগৃহীত
গাজার আকাশে যুদ্ধবিমান, জমিনে ধ্বংস, আর মানুষের মনে ভয়। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় এখন এক ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে—খাদ্য সংকট এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জাতিসংঘ এটিকে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধার্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রায় ২৩ লাখ মানুষের এই জনপদে এখন শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাইই ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধা’য় ভুগছে। এই সংকট শুধু আর অভাব নয়—এটি এখন এক প্রকট দুর্ভিক্ষের পূর্বলক্ষণ।
ইসরাইলের ধারাবাহিক বিমান ও স্থল হামলা এবং কঠোর অবরোধের কারণে গত কয়েক মাস ধরে গাজায় খাদ্য প্রবেশ প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। সীমিত সংখ্যক ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করলেও, তা কোনোভাবেই প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক ব্যাগ আটা, এক প্যাকেট চাল কিংবা সামান্য পানি—এগুলো এখন গাজায় জীবনের সমার্থক হয়ে উঠেছে। দুর্বল শরীর, অনাহারী শিশুদের কান্না, মাতাদের আর্তি, আর পুরুষদের অসহায় দৃষ্টিতে প্রতিটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে জমা হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এ যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির বাঁচার করুণ প্রতিচ্ছবি।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক কার্যালয় ওসিএইচএ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যৌথভাবে যে তথ্য দিয়েছে, তা বিশ্বের বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো। ওসিএইচএ’র মুখপাত্র জেন্স লারকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, গাজা এখন এমন একমাত্র অঞ্চল, যেখানে জনসংখ্যার শতভাগ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে। কোনো অংশিক নয়, পুরো ২৩ লাখ মানুষই সরাসরি ক্ষুধার মুখোমুখি। তিনি আরও বলেন, “গাজায় যত ত্রাণ পাঠানো হয়, তা মূলত মানুষজন লুট করে নেয় কারণ সেগুলোর চাহিদা এত বেশি যে সুশৃঙ্খল বিতরণ সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি জানান, বর্তমানে ৯০০ ট্রাক সীমান্তে অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে ৬০০ ট্রাক কেরেম শালোম বা কারেম আবু সালেম সীমান্ত পর্যন্ত যেতে পেরেছে, কিন্তু মাত্র ৫টি ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। আর সেগুলোর বেশিরভাগ সামগ্রী পৌঁছানোর আগেই লুট হয়ে গেছে।
গাজা সীমান্ত দিয়ে সহায়তা প্রবেশ না করলে এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে জাতিসংঘ একাধিকবার হুঁশিয়ার করেছে। জর্ডানের আম্মানে অবস্থিত জাতিসংঘের গুদামে এক মাসের খাদ্য ও ওষুধ মজুত থাকলেও, সেগুলো সীমান্ত পেরিয়ে গাজায় পৌঁছাতে পারছে না। ঐ গুদামের ত্রাণ একসঙ্গে ২ লাখ মানুষকে সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা রাখে, কিন্তু অবরোধের কারণে সেগুলো পৌঁছাতে পারছে না।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, “সীমান্তের আশপাশে সংঘর্ষ এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীদের উপস্থিতির কারণে ত্রাণ পরিবহন নিরাপদ নয়। এমনকি যেসব ট্রাক প্রবেশ করে, সেগুলোর সরবরাহও নিরাপদে বিতরণ করা যায় না।”
গাজার হাজার হাজার শিশু এখন চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। বহু শিশুর শরীরে এখন হাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ আগেই জানিয়েছিল, গাজায় এক ভয়ংকর শিশুখাদ্য সংকট চলছে। চলমান অবরোধের কারণে শিশু খাদ্য ও জরুরি ওষুধ প্রবেশ করতে না পারায় অনেক শিশু মৃত্যুর মুখে পড়েছে।
গত সপ্তাহেই ২৯ জন মানুষ অনাহারে মারা গেছে, যাদের অনেকেই শিশু। জাতিসংঘ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, পরিস্থিতি এইভাবে চলতে থাকলে মৃতের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছাতে পারে।
গাজার অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তারা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ত্রাণের ট্রাক এলেও সেগুলোর সুনির্দিষ্ট বিতরণ কেন্দ্র নেই, নেই কোনো তালিকাভুক্ত পদ্ধতিও। ফলে যার যা খুশি সেই ছিনিয়ে নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এক ব্যাগ আটা বা এক প্যাকেট ডাল পাওয়ার জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।
একজন বাসিন্দা আল-জাজিরাকে বলেন, “আমি তিনদিন ধরে কিছুই খাইনি। আমার ছেলেটা শুধু পানি খেয়ে ঘুমাচ্ছে। ত্রাণের ট্রাক আসার কথা শুনলেই ছুটে যাই, কিন্তু ফিরে আসি খালি হাতে।”
ইসরাইল দাবি করছে, তারা কিছু কিছু সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম এত স্বল্পসংখ্যক ত্রাণ ট্রাক গাজায় প্রবেশ করছে। গড়ে দিনে যে পরিমাণ সহায়তা দরকার, তার ৯৫ শতাংশই পৌঁছাতে পারছে না।
এছাড়া শুক্রবার যে ৬০টি ট্রাককে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তীব্র সংঘর্ষের কারণে সেগুলোকে আবার লোডিং জোনে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ফলে গাজার ত্রাণ পরিস্থিতি কার্যত স্থবির হয়ে গেছে।
একদিকে জাতিসংঘ উদ্বিগ্নভাবে সংকট পর্যবেক্ষণ করছে, অপরদিকে আরব বিশ্ব থেকে কার্যকর কোনো সহযোগিতা দেখা যাচ্ছে না। ইসরাইল প্রকাশ্যেই জানিয়েছে, আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকে তারা কোনো ধরনের সহযোগিতা পাবে না। এই অবস্থায় ফিলিস্তিনিরা আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে।
এই ভয়াবহ মানবিক সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। যুদ্ধ ও নিরাপত্তা নিয়েই যখন বিশ্বের বড় শক্তিগুলো ব্যস্ত, তখন গাজার মানুষ এক ব্যাগ আটার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এখনও পর্যন্ত গাজায় অবরোধ প্রত্যাহারে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয়নি।
গাজা এখন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়—এটি হয়ে উঠেছে বিশ্ব বিবেকের পরীক্ষা। যখন এক সম্পূর্ণ জনপদ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে, তখন আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব অনেক বেশি। অবিলম্বে মানবিক করিডোর চালু না হলে, গাজা এক ভয়াবহ গণদুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হবে, যা ইতিহাসে এক গভীর কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—কবে থামবে এই নিষ্ঠুরতা? আর কত শিশুর মৃত্যুর পর পৃথিবী জাগবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ