
ছবি: সংগৃহীত
গাজার মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। রোববার (১ জুন) দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত আল-মাওয়াসি এলাকায় আমেরিকান মানবিক সংস্থা পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে কমপক্ষে ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০০ জন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই প্রাণঘাতী ঘটনার তথ্য নিশ্চিত করেছে। নিহতদের মধ্যে ২৮ জনের মরদেহ খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে এবং ২১ জনের মরদেহ রেড ক্রস পরিচালিত ফিল্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়টি। হতাহতদের অধিকাংশই ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার ভোর থেকেই শত শত মানুষ ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে জড়ো হন। অনাহার আর খাদ্যসঙ্কটে দিন কাটানো মানুষগুলো তখন আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু যখন তারা বিতরণ কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছায়, তখনই হঠাৎ করে ইসরাইলি সামরিক যান থেকে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। একই সময়ে আকাশে ওড়ানো ড্রোন থেকেও বিস্ফোরক ছোঁড়া হয়।
এই নির্মম হামলার ফলে ঘটনাস্থলেই বহু মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে। চিকিৎসা কর্মকর্তারা জানান, ওই এলাকা পরিণত হয় এক ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে অ্যাম্বুলেন্সও সহজে পৌঁছাতে পারেনি। অনেক আহতকে ঠেলাগাড়ি, হুইলচেয়ার, এমনকি খালি হাতে বহন করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
এই হামলা শুধু আল-মাওয়াসি এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। একই সময়ে গাজার কেন্দ্রস্থলের নেটজারিম করিডোরের কাছে অপর একটি আমেরিকান ত্রাণকেন্দ্রের দিকে আসা সাধারণ মানুষের ওপরও গুলি চালায় ইসরাইলি সেনারা। সেই হামলার পরিসংখ্যান এখনো পুরোপুরি পাওয়া যায়নি, তবে হতাহতের আশঙ্কা প্রবল।
এছাড়া নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের আল-আউদা হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের কাছে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে আরও একজন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।
এই ভয়াবহ ঘটনায় আন্তর্জাতিক নিন্দার ঝড় উঠলেও, ইসরাইলি সেনাবাহিনী এর দায় স্বীকার করছে না। বাহিনীর মুখপাত্র অভিচাই আদ্রেয়ি দাবি করেছেন, “আমরা এমন কোনো ঘটনা জানি না যেখানে আমাদের গুলিতে ত্রাণকেন্দ্রে হতাহত হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন।”
তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, “ইসরাইল পরিকল্পিতভাবে মানবিক সহায়তাকে যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করেছে। তারা জানে, ক্ষুধার্ত মানুষ ত্রাণ নিতে আসবেই—তাদেরকে একত্র করে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করাই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য।”
তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু এক প্রতিবেদনে জানায়, ইসরাইল এখন দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় চারটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। নামমাত্র এই কেন্দ্রগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমেরিকান সংস্থাগুলোকে।
কিন্তু বিভিন্ন সূত্র বলছে, এই ত্রাণকেন্দ্র পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের গাজার উত্তরের অঞ্চল থেকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে ঠেলে দেওয়া। ইসরাইলি সেনা রেডিও প্রকাশ্যেই বলেছে, তারা চায় গাজার উত্তরাঞ্চলকে “সম্পূর্ণভাবে জনশূন্য” করে দিতে।
এই মার্কিন-সমর্থিত ত্রাণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কেবল ফিলিস্তিনিরা নয়, বরং বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। অনেকেই একে গণহত্যা চালানোর এক নতুন কৌশল হিসেবে দেখছে।
ইসরাইল গত ২ মার্চ থেকে গাজার সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। এতে খাদ্য, পানি, ওষুধ, জ্বালানি—সব ধরনের প্রয়োজনীয় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ত্রাণ ঢোকার অনুমতি দেওয়া হলেও তা গাজার ২৪ লাখ মানুষের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা গাজায় ‘পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ’ শুরু হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এই সময়ে প্রায় ৫৪,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস মৃতের সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৬১,৭০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে হাজার হাজার মানুষ এখনও নিখোঁজ—ধারণা করা হচ্ছে, এদের সবাই নিহত।
ইসরাইলের এই হামলার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়ছে। গত ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ)-এও ইসরায়েল ‘গণহত্যা’র অভিযোগে অভিযুক্ত।
রোববারের এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, গাজায় মানবিক সহায়তা সংগ্রহ করতে যাওয়া সাধারণ নাগরিকরাও ইসরাইলের নিশানা থেকে নিরাপদ নয়। ত্রাণ সংগ্রহ এখন যেন মৃত্যুর সাথে লটারি খেলা—যেখানে বাঁচার আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর জোরালো হস্তক্ষেপ ছাড়া এই মানবিক বিপর্যয় থামার কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ