
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই ২০২৪-এ গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ মাসে দেশজুড়ে অভূতপূর্ব মাত্রায় গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়কালে মোট ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতি মাসেই গ্রেপ্তারের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে গ্রেপ্তারের হার দ্বিগুণ হয়েছে।
ধরপাকড়ের মাসভিত্তিক বিবরণ:
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ১০৯ জন।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৯ জন।
মে মাসেই গ্রেপ্তার হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার ২০৮ জন — গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১,৪৫৮ জন।
তুলনামূলকভাবে আগস্টে গ্রেপ্তার হয় মাত্র ১৫ হাজার ৪৯২ জন, যা বর্তমান সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
পুলিশের দাবি, এই গ্রেপ্তারে রাজনৈতিক এবং অপরাধমূলক কার্যক্রম উভয়ের দায়ীদের ধরা হয়েছে। তবে এই পরিসংখ্যানে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার এবং সাধারণ অপরাধের আলাদা হিসাব নেই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও ডেভিল হান্ট:
২০২৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সম্মিলিত এক অভিযানে ৩২ হাজার ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যার মধ্যে ডেভিল হান্ট নামে অভিযানে ধরা পড়ে ১২ হাজার ৫০০ জন। পরবর্তীতে এই অভিযানের নাম নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ডেভিল হান্ট’ শিরোনামটি বাদ দেওয়া হয়, তবে অভিযান চলমান থাকে।
কারাগারের অবস্থা:
দেশের ৬৯টি কারাগারে মোট ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৮৭ জন, অথচ বর্তমানে বন্দি ৭৩ হাজার ৬ জন।
পুরুষ বন্দি: ৭০,৪১৭
নারী বন্দি: ২,৫৮৯
এর বাইরেও কিশোর সংশোধনাগার এবং কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালগুলোতে আলাদা বন্দির চাপ রয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার:
ধারণক্ষমতা: ৪,৫৯০ জন
বাস্তব বন্দি: প্রায় ৮,২০০ জন
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার:
ধারণক্ষমতা: ২,২৪৯ জন
বাস্তব বন্দি: সাড়ে ৫ হাজারের বেশি
সিলেট ও মেহেরপুর ছাড়া দেশের প্রায় সব কারাগারেই দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ বন্দি রয়েছে।
রাজনৈতিক চাপ, প্রতিক্রিয়া ও অভিযান তীব্রতা:
৮ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করলে অভ্যুত্থানপন্থী ছাত্রনেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। যমুনা সরকারি বাসভবনের সামনে তারা অবস্থান নিলে নতুন করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর ১২ মে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসমূহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে গ্রেপ্তার অভিযান তীব্রতর হয়।
শুধু ঢাকাতেই গত এক মাসে গ্রেপ্তার ২৩৬ জন নেতাকর্মী, যার মধ্যে ৮ জন হলেন সাবেক সংসদ সদস্য।
উল্লেখযোগ্য গ্রেপ্তার:
১৬ মে: জেবুন্নেছা আফরোজ (বরিশাল-৫)
১৪ মে: কাজিম উদ্দিন আহমেদ ধনু (ময়মনসিংহ-১)
১২ মে: মমতাজ বেগম (মানিকগঞ্জ-২)
১০ মে: শামীমা শাহরিয়ার (সুনামগঞ্জ, সংরক্ষিত)
৯ মে: সেলিনা ইসলাম (কুমিল্লা, সংরক্ষিত)
৬ মে: আমিরুল আলম মিলন (বাগেরহাট-৪)
২৭ এপ্রিল: জাফর আলম (কক্সবাজার-১)
২০ এপ্রিল: মনিরুল ইসলাম মনু (ঢাকা-৫)
৯ মে: সেলিনা হায়াৎ আইভী (সাবেক মেয়র, নারায়ণগঞ্জ)
পুলিশ প্রশাসনের ভাষ্য:
অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক শাহজাদা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “পুলিশ এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাই অভিযান জোরদার হয়েছে। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ কার্যক্রমে যুক্ত কেউ প্রকাশ্যে বা অনলাইনে সক্রিয় হলে তাদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
বিশ্লেষক মতামত:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রেপ্তার করলে তা পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়ক হয় না। অপরাধীদের ধরতে হবে অপরাধ বিবেচনায়, দলীয় পরিচয়ে নয়।”
তিনি আরও বলেন, “মোহাম্মদপুর এলাকা ১০ মাসেও স্বাভাবিক করা যায়নি। মব সৃষ্টি, দখল, চাঁদাবাজি যেভাবে চলছে, তাতে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বড় কথা নয় — সঠিক টার্গেটিং গুরুত্বপূর্ণ।”
সারসংক্ষেপ:
৩.৬ লাখের কাছাকাছি গ্রেপ্তার, যার বড় অংশই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ের।
রাজনৈতিক গ্রেপ্তার জোরালো, কিন্তু অপরাধমূলক ঘটনার ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার তুলনামূলক কম।
কারাগারগুলোতে দুই থেকে তিন গুণ বন্দি থাকায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে— “শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।”
সমালোচকরা বলছেন— “রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ