
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী নতুন অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বড় পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে আজ রোববার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাড়া নতুন মুদ্রার নোট বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন এক সিদ্ধান্ত কার্যকর করল, যা মুদ্রা নীতির দিক থেকে যুগান্তকারী বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিস এবং দেশের দশটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখার মাধ্যমে সীমিত পরিসরে ২০, ৫০ এবং ১০০০ টাকার নতুন ডিজাইনের নোট বিতরণ শুরু হয়েছে। নতুন এই নোটগুলোর সবচেয়ে আলোচিত পরিবর্তন হলো—এগুলোতে আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নেই, যা স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে প্রতিটি মুদ্রা ও নোটে বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যমান ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নতুন নোটগুলো আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসহ তৈরি হয়েছে এবং এগুলোর কাগজ, রং ও নিরাপত্তা সুতা আধুনিক মানের। ডিজাইনের দিক থেকেও নোটগুলোতে সমসাময়িক ও রাষ্ট্রনিরপেক্ষ প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চিত করেছে যে নতুন নোট চালু হলেও প্রচলনে থাকা অন্যান্য সব নোট বৈধ থাকবে এবং বাজারে সমানভাবে চালু থাকবে।
বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় অঙ্কের লেনদেন নিরাপদ রাখতে এবং জনগণের মধ্যে নতুন ডিজাইন নিয়ে কৌতূহল কমাতে এই নোটগুলো প্রথমে সীমিত পরিসরে বিতরণ করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহগুলোতে ধীরে ধীরে এই নতুন মুদ্রা পুরো দেশব্যাপী বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আজকের বিতরণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস ছাড়াও আরও ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্ধারিত শাখায় নতুন নোট বিতরণ করা হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো হলো: সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক।
উল্লেখ্য, প্রতিটি ব্যাংকের লোকাল অফিস পর্যায়ে টাকা বিতরণ করা হয়েছে, অর্থাৎ এসব ব্যাংকের কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোতেই এখন নতুন নোট পাওয়া যাচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্যান্য শাখায় সরবরাহ বাড়ানো হবে।
অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন নোট থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি বাদ দেওয়া নিছক ডিজাইনের পরিবর্তন নয়; বরং এটি এক বৃহৎ রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে। ‘জুলাই বিপ্লব’-এর মাধ্যমে যে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তারই অংশ হিসেবে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতীকের পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত তারই প্রতিফলন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, “নতুন প্রশাসনের দিকনির্দেশনার আলোকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা এবং সর্বজনগ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে মুদ্রায় রাজনৈতিক প্রতিকের পরিবর্তন আনা হয়েছে।” তবে তিনি নিশ্চিত করেন, “এই পরিবর্তন কেবল প্রতীকি নয়, মুদ্রানীতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও আধুনিকীকরণের কৌশলগত দিক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।”
আজ সকাল থেকেই মতিঝিল এলাকার বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসে নতুন নোট নিতে জনসাধারণের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। অনেকে কৌতূহল নিয়ে নতুন নোট সংগ্রহ করছেন, কেউ কেউ আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে প্রতিক্রিয়াও জানাচ্ছেন।
ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত মো. আরিফ বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাড়া মুদ্রা দেখা আমার জীবনে প্রথম। ভালো না খারাপ তা জানি না, তবে এটা যে একটা ঐতিহাসিক পরিবর্তন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
অন্যদিকে একজন সিনিয়র নাগরিক আব্দুল করিম বলেন, “বঙ্গবন্ধু তো এই রাষ্ট্রের জন্মদাতা। ওনার ছবি যদি না থাকে, তবে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা শুরু হবে কিনা, সেটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পরবর্তী ধাপে ৫, ১০, ১০০ ও ৫০০ টাকার নতুন নোটও ধাপে ধাপে বাজারে ছাড়া হবে। একইসঙ্গে সব ধরনের কয়েনের ডিজাইনও পরিবর্তনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নতুন নোটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরিচয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রতীকের নতুন সংজ্ঞা গড়ে তোলার লক্ষ্য রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সব মিলিয়ে বলা যায়, শুধু নতুন নোট বিতরণ নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রচিন্তার প্রেক্ষাপটে এক যুগান্তকারী পর্বের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ