
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার অবস্থা বর্তমানে গভীর সংকটের মুখে। গত পাঁচ মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণপিটুনির শিকার হয়ে অন্তত ৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। দারুসসালামের সাম্প্রতিক পিটুনি-হত্যার ঘটনা আবারো এই সংকটকে সামনে এনে দিয়েছে। সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সংখ্যালঘু ও সাধারণ মানুষের ওপর সহিংসতা এবং বিভিন্ন ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) তাদের সাম্প্রতিক পাঁচ মাসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গণপিটুনি, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার, সাংবাদিক নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতা, নারীর ওপর সহিংসতা, ধর্ষণ, অপহরণ এবং সীমান্তে পুশইনসহ নানাবিধ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়ছে। শুধু তাই নয়, কারাগারে হাজতিদের মধ্যে মৃত্যুর হারও গত মাসে বেড়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত গণপিটুনির শিকার হয়ে অন্তত ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এমএসএফ’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মাসে মাত্র ৩৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সাতজন নিহত হয়েছেন এবং অন্তত ৩৮ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়া এই পাঁচ মাসে প্রায় আড়াই শতাধিক অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যা সামাজিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ প্রমাণ।
সম্প্রতি রাজধানীর দারুসসালামের হাড্ডিপট্টি এলাকায় দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা এই চিত্রকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “গণপিটুনি ও বিচারবহির্ভূত হত্যার এই প্রবণতা সামাজিক অস্থিতিশীলতার বড় দৃষ্টান্ত। এটি শুধুমাত্র আইনের ব্যর্থতা নয়, বরং সমাজের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও অসংযমের প্রতিফলন।” – বলেন সমাজ বিজ্ঞানী ড. সামিউল হক।
গত পাঁচ মাসে সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতার ঘটনা শতাধিক বার ঘটেছে। এমএসএফ’র রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু মে মাসেই ৪১টি ঘটনায় ১০১ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হামলা, মামলা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আগের মাসের তুলনায় এই ধরনের ঘটনা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
মুক্ত সংবাদ মাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. লিয়াকত আলী বলেন, “সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হয়রানি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য একটি বড় সঙ্কেত, যা দীর্ঘমেয়াদে তথ্যপ্রবাহের স্বচ্ছতা ও সমাজের সচেতনতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘর্ষে গত পাঁচ মাসে প্রায় অর্ধশতজন নিহত হয়েছেন এবং অগণিত আহত হয়েছেন। মে মাসেই রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩৫৯ জনের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যেখানে আটজন নিহত ও ৩৫১ জন আহত হয়েছেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন নয়জন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক খন্দকার রাশেদুল ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক সহিংসতা দেশের সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনীতির অবাধ নিয়ন্ত্রণহীনতারই চিত্র। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অসৎ স্বার্থে এ ধরনের সহিংসতা উস্কে দিতে অভ্যস্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত হচ্ছে।”
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা গত পাঁচ মাসে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমএসএফ’র তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে অন্তত ৩৮৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৯৮টি দলবেঁধে ধর্ষণ এবং ১৬টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা। এছাড়াও, গত মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৩৬৮টি ঘটনা ঘটে, যেখানে ৮৬ জন নিহত এবং ৫৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
নারী অধিকার সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সাবরিনা পারভীন বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতার এই বৃদ্ধি দেশের আইন ও সমাজ ব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রকাশ করে। এটা স্পষ্ট যে, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে যথাযথ নীতিমালা ও কঠোর বাস্তবায়নের প্রয়োজন।”
কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা গত পাঁচ মাসে নিয়মিত ঘটছে। মে মাসে সাতজন কারাগারে মারা গেছেন, যার মধ্যে তিনজন কয়েদি ও চারজন হাজতি। এই সংখ্যা আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে। কারা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ হায়দার আলী বলেন, “কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক নরকীয় দৃষ্টান্ত, যা কারা ব্যবস্থাপনার গভীর ব্যর্থতা নির্দেশ করে।”
সীমান্ত এলাকাতেও গত মাসে বিএসএফের গুলিতে দুজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এছাড়া আটজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও নির্যাতনের তথ্য পাওয়া গেছে। একই সাথে আরাকান আর্মির গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত এবং তিনজনকে আটক করার ঘটনা ঘটেছে, যা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উত্তেজনার মাত্রা বাড়িয়েছে।
সীমান্ত বিষয়ক বিশ্লেষক জাফর ইকবাল বলেন, “সীমান্তে এ ধরনের সহিংসতা এবং নির্যাতন দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক চাপ ও সমাধান জরুরি।”
বর্তমান সময়ে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, এটি শুধুমাত্র একটি জাতীয় সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদেরও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা সরকারকে কঠোর এবং স্থায়ী সমাধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে দেশের মানুষ নিরাপদে ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের নেতৃত্বাধীন এমএসএফ’র এই প্রতিবেদন জনগণের চোখে বাস্তবতার আঙ্গিনার এক পীড়াদায়ক চিত্র তুলে ধরেছে। ফলে এই সংকট মোকাবেলায় দ্রুত নীতিগত সংস্কার ও বাস্তবায়ন না হলে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ