
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান অংশীদার জাপানের কাছ থেকে আবারও একটি বড় অঙ্কের অর্থনৈতিক সহায়তা পেতে যাচ্ছে। সম্প্রতি জাপানের রাজধানী টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে মোট ১.০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১২ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার ঋণ ও অনুদান সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই ঋণ সহায়তা ব্যবহার করা হবে বাংলাদেশ সরকারের বাজেট-সহায়তা, রেলপথ উন্নয়ন এবং শিক্ষাখাতের বৃত্তি সহায়তার উদ্দেশ্যে।
এই চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শুক্রবার সকালে তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান, চুক্তির আওতায় জাপান বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে নিম্নলিখিত তিনটি খাতে মোট ১.০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করবে:
-
অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৪১৮ মিলিয়ন ডলার (৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলার)
-
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথকে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনে রূপান্তরের জন্য ৬৪১ মিলিয়ন ডলার (৬৪ কোটি ১০ লাখ ডলার)
-
উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি অনুদান হিসেবে অতিরিক্ত ৪২ লাখ ডলার
এই অর্থনৈতিক প্যাকেজটি শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, রেল যোগাযোগে আধুনিকীকরণ এবং উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে।
টোকিওতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এবং কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা
এই ঋণ চুক্তির পটভূমিতে ছিল বাংলাদেশ ও জাপানের দুই প্রধান নেতার মধ্যে অনুষ্ঠিত এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। শুক্রবার সকালে অধ্যাপক ইউনূস জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে তাঁকে রাজকীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবারের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা দুই দেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বৈঠকে তারা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে গভীর আলোচনা করেন এবং জাতিসংঘ সনদের মৌলিক নীতিমালাকে সমুন্নত রেখে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। উভয় নেতা আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে বহুপাক্ষিকতাকে সমর্থনের আশ্বাস দেন।
যৌথ বিবৃতি ও বহুমুখী সহযোগিতা
বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে খোলামেলা ও গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। বিশেষভাবে আলোচিত হয় মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (MIDIP) এবং বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প বৃদ্ধি বেল্ট (BIG-B) প্রকল্পের আওতাধীন বিভিন্ন উদ্যোগ।
জাপান সরকার বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, তার জন্য অধ্যাপক ইউনূস কৃতজ্ঞতা জানান এবং এই প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।
বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণ উদ্যোগ
বৈঠকে দুই পক্ষ বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সম্মত হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
-
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওয়ান স্টপ সার্ভিস (OSS) সিস্টেম উন্নয়ন
-
প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন
-
ব্যাটারি-চালিত সাইকেল কারখানা স্থাপন
-
তথ্য সুরক্ষার জন্য পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন
-
বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (BSEZ) সম্পর্কিত ভূমি চুক্তি
এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি নিরাপদ ও সহজলভ্য পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
ইপিএ এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় অগ্রগতি
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (EPA) দ্রুত সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তার ওপর উভয় নেতা জোর দেন। তারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও আলোচক দলগুলোকে দ্রুত চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আলোচনা ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দেন।
একইসাথে জাপানের অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স (OSA) প্রোগ্রামের অধীনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য পাঁচটি টহল নৌকা দ্রুত সরবরাহ করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি স্থানান্তর বিষয়ক একটি চুক্তিতেও দুই সরকার নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং তা দ্রুত সম্পন্ন করার আশা প্রকাশ করেছে।
মানবসম্পদ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়
বৈঠকে দুই দেশের জনগণের মধ্যে বিনিময় বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদারে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে, যার মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্ক আরও হৃদ্যতাপূর্ণ হবে বলে নেতৃবৃন্দ আশা প্রকাশ করেন।
এই ঋণ সহায়তা ও কৌশলগত চুক্তিসমূহ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা করবে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জাপানের মতো উন্নত অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে এধরনের বহুমুখী অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও মজবুত করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ