
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বিদেশি ঋণ পরিশোধে প্রায় ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। এ পরিমাণের মধ্যে ১২৯ কোটি ডলার সুদ ও ২২১ কোটি ডলার আসল ঋণ পরিশোধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩ কোটি ডলার বেশি, যা দেশের ঋণ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে—বিশেষ করে অনেক বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) জুলাই-এপ্রিল মাসের ঋণ পরিশোধ সম্পর্কিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঋণ পরিশোধ বাড়লেও বৈদেশিক ঋণের নতুন প্রতিশ্রুতি ও ঋণ ছাড়ের পরিমাণ প্রত্যাশার তুলনায় কমে গেছে, যা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সতর্কতার সংকেত দেয়।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়েছে, যার গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ শোধের জন্য নির্দিষ্ট সময়) শেষ হওয়ায় ঋণ পরিশোধের চাপ তীব্র হচ্ছে। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক বাজারে উচ্চ সুদের হার ঋণ পরিশোধকে আরও জটিল করে তুলেছে। এতে সরকারকে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণ শোধে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় এখন থেকে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়বে। সরকারের বাজেটে ঋণ পরিচালনার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা জরুরি, না হলে অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে,” মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. হাসান আলী।
এই প্রথম ১০ মাসে দেশের বৈদেশিক ঋণের নতুন প্রতিশ্রুতি এসেছে মাত্র ৪২৬ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩৪ কোটি ডলার কম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ ছাড়ের পরিমাণও কমে ৫১৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত অর্থবছরের ৬২৮ কোটি ডলারের তুলনায় ১১২ কোটি ডলার কম।
অর্থনীতিবিদ ড. রেশমা খান মন্তব্য করেছেন, “ঋণ প্রতিশ্রুতি ও ঋণ ছাড় কমে যাওয়ায় সরকারের ঋণ সংগ্রহের সুযোগ সীমিত হচ্ছে। এটি দেশের বড় মেগা প্রকল্পগুলোতে প্রভাব ফেলতে পারে এবং বাজেট সংকোচনের পথ খুলে দিতে পারে।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আসল ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৩২.৮৬ শতাংশ, যেখানে সরকার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণ শোধ করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে আসল ঋণ পরিশোধ ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি ডলার। এর পাশাপাশি সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১২.৯৫ শতাংশ, যা প্রায় ১২৯ কোটি ডলার দাঁড়িয়েছে। গত বছর এটি ছিল ১১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক শেখ মুশফিকুর রহমান বলেন, “ঋণ শোধের এই দ্রুত বৃদ্ধি সরকারের আর্থিক দায়ভার বাড়াচ্ছে। তবে এটি স্বল্পমেয়াদে দেশের ঋণস্বচ্ছলতার জন্য ইতিবাচক, কারণ ঋণ কমানোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে সুদের বোঝা কমানো সম্ভব হবে।”
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর পরামর্শে বাংলাদেশে ঋণের কার্যকর ব্যবস্থাপনা জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন ঋণ গ্রহণে সীমাবদ্ধতা আরোপ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রাধান্য দিয়ে দেশের ঋণ পুনর্গঠন করা উচিত।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রণালয় কর্মকর্তা মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, “বর্তমান ঋণ পরিশোধের গতি ধরা দেয় যে দেশের অর্থনীতি ঋণমুক্তির পথে এগোচ্ছে, তবে উন্নয়ন প্রকল্প ও বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখতে সুদ ও আসল ঋণের মধ্যে একটি সুষ্ঠু সমন্বয় প্রয়োজন।”
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে গত বছরের তুলনায় আরও বেশি অগ্রসর হয়েছে, তবে ঋণ গ্রহণে কমতি ও ঋণ ছাড়ের পরিমাণ কমে যাওয়া ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জোরদার মনোযোগের আহ্বান জানাচ্ছে। ঋণ শোধের এই চাপ মোকাবেলায় দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক নীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ