
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেতই বয়ে আনছে বেসরকারি বিনিয়োগে মারাত্মক পতনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার নেমে এসেছে মাত্র ২২.৪৮ শতাংশে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের অর্থবছরে এই হার ছিল ২৩.৯৬ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পতন শুধু একখণ্ড পরিসংখ্যান নয়, বরং দেশের অর্থনীতিতে আস্থার সংকট, বিনিয়োগ পরিবেশের অবনতি এবং ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের ওপর একটি বড় ধরনের হুমকি।
বিনিয়োগে পতনের পেছনে কী?
করোনা মহামারির পর ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের হার যতটা নিচে নেমেছিল, বর্তমান হার তার কাছাকাছি। ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, সুদের উচ্চ হার এবং অব্যাহত আমদানি সংকট বেসরকারি বিনিয়োগে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)-এর সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি বিনিয়োগকারীদের ক্রমবর্ধমান আস্থাহীনতার প্রতিফলন। গ্যাসের দাম বাড়লেও সরবরাহে অনিয়ম, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট এবং ঋণের সুদহার ১৬-১৭ শতাংশে উন্নীত হওয়ায় ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বল শৃঙ্খলা বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারের ভেতরে নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে একধরনের ছন্দপতন দেখা যাচ্ছে।”
ঋণ ও আমদানিতে মন্দা
বিবিএস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মার্চ মাসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭.৫৭ শতাংশে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। একইসঙ্গে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ২৬ শতাংশ কমে এসেছে এবং তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৮ বিলিয়ন ডলারে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো—শিল্প স্থাপন ও সম্প্রসারণ থমকে গেছে, যা ভবিষ্যতের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সংকুচিত করবে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বেসরকারি বিনিয়োগের পতন খুবই উদ্বেগজনক। এটি সরাসরি কর্মসংস্থান ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে। এই পতন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার ও কাঠামোগত দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। বিনিয়োগ না বাড়লে টেকসই প্রবৃদ্ধি কখনো সম্ভব নয়।”
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ মন্তব্য করেন, “বিনিয়োগের এই পতন দেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট সতর্ক সংকেত। এটি পরিসংখ্যানগত বিষয় নয়, বরং দেশজুড়ে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তারই প্রতিফলন। উৎপাদন বাড়াতে ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিতে হবে।”
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “মূল্যস্ফীতি, সুদের উচ্চ হার, ডলার সংকট এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা চূর্ণ করে দিচ্ছে। সরকার যদি কাঠামোগত সংস্কারে আরও গতি না আনে, তাহলে এই মন্দা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে।”
লক্ষ্যমাত্রা এখন অনেক দূরে
আওয়ামী লীগ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৮.২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে বর্তমান অবস্থা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই লক্ষ্য এখন ক্রমেই অধরা হয়ে পড়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, “প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ নতুন তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এই বিশাল জনসংখ্যাকে কর্মে লাগাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। আর বিনিয়োগ না বাড়লে বেকারত্ব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।”
সমাধান কী?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচিত—
-
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা
-
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
-
ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট দূর করা
-
সুদের হার সহনীয় রাখা
-
কাঠামোগত সংস্কারে গতি আনা
-
আমদানি নীতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
-
বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া
বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনীতি সচল থাকবে না। সেই বিনিয়োগ যদি বেসরকারি খাত থেকে না আসে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা—দুটিই তীব্র অনিশ্চয়তায় পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ