ছবি: সংগৃহীত
জাপানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, "দেশের অর্থনীতি এখন সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর পর্যায়ে রয়েছে। এ সময় প্রবাসীদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের পথে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারে।"
শুক্রবার (৩০ মে) বিকেলে টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে জাপান প্রবাসীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের উচ্চ শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা অর্জন করছেন। এই অর্জিত জ্ঞান এখন দেশের 'মেরামত' বা পুনর্গঠনের কাজে লাগানোর উপযুক্ত সময়।"
তিনি আরো বলেন, "আগের সরকার দেশের ব্যাংক ও কোষাগার শূন্য করে রেখে গেছে। তাদের দুঃশাসনের কারণে অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর অবস্থায়। তবে আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক কাঠামোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যেই কিছুটা গতি এসেছে। আমরা মনে করি, প্রবাসীদের সাহায্য ছাড়া একটি টেকসই অর্থনৈতিক পুনর্গঠন সম্ভব নয়।"
প্রধান উপদেষ্টা এ সময় এক দৃষ্টান্তমূলক বার্তা দেন: "শুধু রেমিট্যান্স পাঠানো নয়, এখন প্রবাসীরা তাদের অভিজ্ঞতা, গবেষণা, প্রযুক্তি জ্ঞান এবং নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখার সময় এসেছে। জাপান প্রবাসীরা প্রযুক্তি, চিকিৎসা, নির্মাণ, ব্যবসা, গবেষণা, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নানা ক্ষেত্রে যেভাবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন, তা দেশেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সরকারের পক্ষ থেকে সেই পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের সেবা খাত এবং শিল্পখাতকে আধুনিকায়ন করতে বিদেশফেরত শিক্ষিত জনশক্তির বড় প্রয়োজন।"
সভায় জনশক্তি রফতানি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, "সরকার এখন সচেতনভাবে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণে মনোযোগ দিচ্ছে। আমরা জাপানে আরও বেশি জনশক্তি রফতানির জন্য একটি নীতিগত কাঠামো গড়ে তুলতে চাই। দক্ষতা উন্নয়ন, ভাষা শিক্ষা এবং জাপানি সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "জাপান সরকারের সঙ্গেও এই বিষয়ে আমরা ইতিবাচক আলোচনায় আছি। আমরা চাই, যে প্রবাসীরা আসছেন, তারা শুধু শ্রমিক না হয়ে দক্ষ অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠুক।"
সভায় উপস্থিত প্রবাসীরা বিভিন্ন নাগরিক সেবা নিয়ে সমস্যার কথা জানালে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দেন, বর্তমান সরকার প্রশাসনিক কাঠামোকে আধুনিক ও ডিজিটাল করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি বলেন, "সরকার চাইছে, প্রবাসীরা ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে পাসপোর্ট নবায়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন বা আবেদন, জমির তথ্য যাচাই, রেমিট্যান্স সম্পর্কিত তথ্য প্রাপ্তি ইত্যাদি সেবা পেতে পারেন। এরই মধ্যে কয়েকটি দূতাবাসে পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাল নাগরিক সেবা চালু করা হয়েছে। টোকিও দূতাবাসেও অচিরেই এ ধরনের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হবে।"
সভায় উপস্থিত প্রবাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে পাসপোর্ট নবায়নের জটিলতা, এনআইডি সংশোধনের সমস্যা, দূতাবাসের সেবার গুণগতমান, শিক্ষা ও চাকরির স্বীকৃতির অভাব, জাপান সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিতভাবে মতামত তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং প্রত্যেকটি বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, "আপনাদের সমস্যা জানলে আমরা আরও ভালোভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। শুধু অভিযোগ করলেই হবে না, দেশকে বদলাতে হলে সক্রিয় অংশগ্রহণও করতে হবে। আপনারা সরকারকে তথ্য দিন, আমরা কাজ করব।"
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়, যেখানে দুই দেশের মধ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এই চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে—কৌশলগত অংশীদারিত্ব, শিক্ষা ও গবেষণা বিনিময়, জ্বালানি সহযোগিতা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "এই চুক্তিগুলোর সুফল যেন সরাসরি প্রবাসী বাংলাদেশিরা পান, তা নিশ্চিত করতেই আজ আপনাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে এসেছি।"
জাপানে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভাটি ছিল কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ছিল এক আন্তরিক আহ্বান—বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের দেশের প্রতি নতুন করে দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা। ড. ইউনূসের কণ্ঠে ছিল জাতিকে সংকট থেকে উত্তরণের এক আশাবাদী ডাক—বিদেশে অর্জিত শিক্ষা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে আসুন, দেশের মেরামতের কাজে শামিল হোন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



