
ছবি: সংগৃহীত
কুরবানি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আল্লাহতায়ালার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, ত্যাগ এবং বিসর্জনের এক বিশাল শিক্ষণীয় উদাহরণ। আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসূলের যুগে কুরবানির ঐতিহ্য অটুট রয়েছে। কুরবানি শুধু ঈদুল আজহার একটি রীতি নয়, এটি শাআইরে ইসলাম বা ইসলামের প্রতীকী বিধানাবলির অন্তর্ভুক্ত, যা মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।
কুরবানির তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য
কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, গরিব ও দুঃখীদের সাথে ভাগাভাগি করার মাধ্যমে সৌহার্দ্য বৃদ্ধি, এবং রাসুল (সা.) ও আল্লাহর শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে নির্দেশ দিয়েছেন, “আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি আদায় করুন।” (সূরা কাওসার: ২) এছাড়াও আয়াতে এসেছে, “আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত।” (সূরা আনআম: ১৬২)
কুরবানি কাদের জন্য ওয়াজিব?
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ ও পূর্ণবুদ্ধিসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও মহিলার উপর কুরবানি ওয়াজিব যদি:
তারা ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে, বিশেষ করে ১০ জিলহজের ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে,
নেসাব পরিমাণ সম্পদ রাখে, অর্থাৎ কুরবানির জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ বা সম্পদের মালিক হয়।
এই সম্পদের মধ্যে টাকার পাশাপাশি সোনা, রূপা, অলঙ্কার, ব্যবসার মালামাল, অতিরিক্ত জমি, বাড়ি বা অন্যান্য প্রয়োজনাতিরিক্ত বস্তু গণ্য হবে।
নেসাব হল:
স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি,
রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি,
অথবা টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমপরিমাণ।
যদি এককভাবে না হয়, তবে বিভিন্ন বস্তু মিলিয়ে এই নেসাবের সমপরিমাণ সম্পদ থাকলেও কুরবানি ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ স্বর্ণ ও টাকা মিলিয়ে নেসাব পূরণ হলে কুরবানি করা জরুরি।
একাধিক ব্যক্তির কুরবানির দায়িত্ব
একান্নভুক্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা নেসাব সম্পদের মালিক, তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা কুরবানি ওয়াজিব। একটি পশু দিয়ে পরিবারের সকলের কুরবানি দেয়া যায় না। প্রত্যেককে নিজস্ব পশু কুরবানি করতে হবে অথবা বড় পশুর ক্ষেত্রে ভাগ করে কুরবানি করতে হবে।
নেসাবের মেয়াদ ও সময়সীমা
পুরো বছর ধরে নেসাব থাকতে হবে এমন নিয়ম নেই। ১২ জিলহজের সূর্যাস্তের আগে তিন দিন যদি নেসাবের মালিকানায় আসেন, তবে কুরবানি ওয়াজিব হবে।
কুরবানির পশুর বয়স ও গুণাবলী
উট: ন্যূনতম ৫ বছর,
গরু ও মহিষ: ন্যূনতম ২ বছর,
ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা: ন্যূনতম ১ বছর (৬ মাসের বেশি হলে হৃষ্টপুষ্ট হলে জায়েজ).
ছাগল ১ বছরের কম হলে কুরবানি জায়েজ নয়।
পশুতে শরীকের সংখ্যা
এক ছাগল, ভেড়া বা দুম্বায় একজনই শরীক হতে পারবেন, একাধিক শরীক হলে কুরবানি বাতিল।
উট, গরু বা মহিষে সর্বোচ্চ ৭ জন শরীক হতে পারবেন, ৭ এর বেশি হলে কুরবানি বাতিল।
হারাম উপার্জনের সঙ্গে কুরবানি
যদি নিশ্চিত হয় কারো কুরবানি হারাম টাকায় হয়, তার সঙ্গে কুরবানি জায়েজ নয়। এমন শরীক হলে পুরো কুরবানি বাতিল হবে। তবে অজানা থাকলে কুরবানি জায়েজ।
পশুর অবস্থা ও কুরবানি
শুস্ক, দুর্বল এবং হেঁটে যেতে অক্ষম পশু দিয়ে কুরবানি জায়েজ নয়।
দাঁতহীন বা খাদ্য গ্রহণে অক্ষম পশুর কুরবানি গ্রহণযোগ্য নয়।
শিং একেবারে ভেঙে গেলে কুরবানি বাতিল, তবে কিছুটা ভাঙা বা অর্ধেক ভাঙা হলে জায়েজ।
কান বা লেজ অর্ধেকের বেশি কাটা থাকলে কুরবানি জায়েজ নয়, জন্মগত ছোট কান অসুবিধা সৃষ্টি করে না।
পশু কেনার পর দোষ দেখা দিলে
ভালো পশু কেনার পর যদি দোষ ধরা পড়ে যা কুরবানি বাতিল করে, তাহলে আরেকটি পশু কুরবানি করতে হবে। গরীব হলে ত্রুটিযুক্ত পশু দিয়েই কুরবানি করা যাবে।
শরীকের মৃত্যু বা পশুর ক্ষতি
কুরবানি জবাইয়ের আগে শরীকের মৃত্যু হলে ওয়ারিসদের অনুমতি পেলে কুরবানি চালানো যাবে। পশু চুরি বা মারা গেলে আরেকটি পশু কুরবানি করতে হবে যদি ওয়াজিব থাকে।
ঋণ করে কুরবানি
কুরবানি ওয়াজিব ব্যক্তির ঋণ করে কুরবানি আদায় হয়ে যাবে, তবে সুদের ঋণ থেকে কুরবানি করা যাবে না।
কুরবানি করার সময়
১০ ও ১১ জিলহজের রাতে কুরবানি করা জায়েজ, তবে আলো কম থাকলে ত্রুটি হতে পারে। আলো থাকলে রাতে কুরবানি কোনো সমস্যা নেই।
কুরবানির গোশত নিয়ে নিয়মাবলী
পশুর কোনো অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নয়, গোশতও কাজের লোককে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না।
কাজের লোকদেরও পরিবারের সদস্যদের মতো গোশত খাওয়ানো যাবে।
কুরবানির গোশত বিয়ে, ওলীমাসহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে বিতরণ ও খাওয়ানো জায়েজ।
কুরবানি অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে, শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের জন্য কুরবানি হলে আদায় হবে না।
কুরবানির জন্য নির্ধারিত মাসয়ালা ও শর্তাবলী মেনে চলা ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার প্রকাশ। প্রতিটি মুসলমানের উচিত কুরবানির এই ইবাদত সঠিকভাবে আদায় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কুরবানি শুধু পশু জবাইয়ের নাম নয়, এটি আত্মত্যাগ ও নেককর্মের প্রতীক যা সমাজে দরিদ্রদের সহযোগিতা ও ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে এসব মাসয়ালা জানা ও অনুসরণ করা আবশ্যক, যাতে ইবাদত সঠিক ও পূর্ণতা পায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ