
ছবি: সংগৃহীত
হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর আদেশে যে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা মুসলিম জাহানে আজও কুরবানির মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই আত্মত্যাগ ছিল শুধু একটি পবিত্র কর্ম নয়, বরং এক কঠিন পরীক্ষায় পিতা ও পুত্রের পূর্ণ আনুগত্য, ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার এক অপূর্ব নিদর্শন। এই শিক্ষারই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে প্রতি বছর মুসলমানদের উদযাপিত ঈদুল আজহা এবং তার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ইবাদত, যার মধ্যে একটি বিশেষ আমল হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে চুল, নখ ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় লোম না কাটা।
ইসলামের অন্যতম শিক্ষা হলো আল্লাহর প্রতি নিখাদ আনুগত্য ও দাসত্ব। হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর ঘটনা কেবল ইতিহাসের এক অধ্যায় নয়; বরং এ এক চিরন্তন দৃষ্টান্ত, যা প্রতিটি মুমিনের জীবনে অনুসরণীয়। জাহেলি যুগের আরবরা যদিও আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকার করত, তবুও ইবাদত ও কুরবানির সময় তারা অন্যান্য মূর্তি, দেবতা ও প্রাকৃতিক বস্তুকে আল্লাহর অংশীদার বানিয়ে ফেলত। কুরবানি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো সেই শিরকী ধারা থেকে মানুষকে মুক্ত করে আল্লাহর একত্ববাদে অভ্যস্ত করারই শিক্ষা।
ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, তবে তা সকলের ওপর ফরজ নয়। কুরবানি ওয়াজিব তাদের ওপর যাদের কাছে কুরবানি দেওয়ার মতো সম্পদ আছে, অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণ নেসাব বা সম্পদ যাদের মালিকানা রয়েছে। তবে ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই যে, যাদের কুরবানির সামর্থ্য নেই, তারাও নির্দিষ্ট কিছু আমল পালনের মাধ্যমে পূর্ণ কুরবানির সওয়াব লাভ করতে পারেন।
নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, “যখন তোমরা জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাও এবং তোমাদের কেউ যদি কুরবানি করতে চায়, তাহলে সে যেন তার চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।” (সহীহ মুসলিম: হাদিস ১৯৭৭)। অর্থাৎ জিলহজ মাসের শুরু থেকে ঈদের দিন কুরবানি করার আগ পর্যন্ত নখ, চুল ও অপ্রয়োজনীয় লোম না কাটা মুস্তাহাব হিসেবে বিবেচিত। এতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও একটি সামান্য কাজের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের শিক্ষা নিহিত।
একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে আমর ইবনে আস (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি নবীজিকে প্রশ্ন করেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমার কাছে কুরবানির পশু নেই, কেবল ধার করা একটি দুধ দেওয়ার ছাগল আছে। আমি কী করব?” উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, “না, তুমি কুরবানি করবে না। বরং তোমার চুল, নখ, গোঁফ কাটো এবং নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করো। এতে তুমি একটি পূর্ণ কুরবানির সওয়াব পাবে।” (সুনানে নাসায়ী: ৪৩৬৫; আবু দাউদ: ২৭৮৯)
চুল ও নখ না কাটা মূলত একজন মুমিনের কুরবানি দেওয়ার প্রস্তুতির প্রতীক। এই সময়কালকে ‘মহান দিন’ বলা হয়—এই দিনগুলোতে বেশি বেশি নফল ইবাদত, রোজা, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা এবং আত্মসংযম পালন করতে বলা হয়েছে। চুল-নখ না কাটা দিয়ে একজন মুমিন আল্লাহর প্রতি নিজের নিয়ত ও নিষ্ঠা প্রকাশ করে।
হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাযহাবের অধিকাংশ ফকিহগণ এই হাদিসের ভিত্তিতে বলেন, কুরবানিদাতার জন্য জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে কুরবানির আগ পর্যন্ত নখ, চুল, গোঁফ ও অপ্রয়োজনীয় লোম না কাটা মুস্তাহাব। তবে কেউ যদি চুল-নখ এত বেশি বড় করে ফেলেন যে তা অস্বস্তি বা অপবিত্রতার কারণ হয়, তাহলে তা কেটে ফেলা জায়েজ রয়েছে।
চলতি ২০২৫ সালে ঈদুল আজহার সম্ভাব্য তারিখ ধরা হচ্ছে ৭ বা ৮ জুন। সে অনুযায়ী, ২৮ মে বুধবার দিবাগত রাতে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা কুরবানি করতে চান, তারা ২৮ মে (বুধবার) সন্ধ্যার আগেই চুল, গোঁফ, নখ ও অন্যান্য লোম কেটে ফেলার কাজটি সম্পন্ন করে নিতে পারেন। এরপর জিলহজ মাস শুরু হলে তা আর কাটা যাবে না, যতক্ষণ না কুরবানি সম্পন্ন হয়।
ইসলামী শরিয়তে সহজতা রয়েছে। কেউ যদি ঈদের দিন সকালে ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন করতে না পারেন, তাহলে দুপুর, বিকেল এমনকি রাতেও তা করা যাবে। এমনকি ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনেও করা বৈধ। তবে প্রথম দিনেই তা সম্পন্ন করাই উত্তম এবং মুস্তাহাব।
ক্ষৌরকার্য বলতে চুল, নখ, গোঁফ এবং নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করাকে বোঝানো হয়েছে। দাড়ি শেভ করা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এক মুষ্ঠির নিচে দাড়ি কাটা ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে মাকরূহে তাহরিমি, অর্থাৎ কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত।
যারা কুরবানি দিতে পারবেন না, তারাও যদি ঈদের দিন নামাজ পড়ে এসে এই ক্ষৌরকার্য পালন করেন, তাহলে তারা আল্লাহর দরবারে কুরবানির সমপর্যায়ের সওয়াব লাভ করবেন। এটি ইসলামের উদারতা ও আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের প্রমাণ।
কুরবানি শুধু পশু জবাই নয়, বরং আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য এবং ইবাদতের সর্বোচ্চ রূপ। জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন এই আনুগত্য প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। তাই কুরবানিদাতাদের জন্য চুল, নখ ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় লোম না কাটা একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও মুস্তাহাব আমল। ইসলামী জীবনধারায় এমন ছোট ছোট আমলই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের পাথেয় হতে পারে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই মুবারক দিনগুলোতে সর্বোচ্চ ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ