
ছবি: সংগৃহীত
আজকের দুনিয়ায় আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে মনোযোগ ধরে রাখা যেন এক বিরল প্রতিভা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিমুহূর্তে মোবাইল স্ক্রিনে ঝলকে ওঠা নোটিফিকেশন, সোশ্যাল মিডিয়ার দ্রুত পরিবর্তনশীল কনটেন্ট, অফিসের কাজের চাপ, পারিবারিক দায়িত্ব, এবং দুনিয়ার হাজারো টানাপোড়েনের মধ্যে একটি বিষয় ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠছে—মানবমনের একাগ্রতা ও স্থিরতা।
গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক যুগে মানুষের মনোযোগের গড় সময়সীমা নেমে এসেছে ৮ সেকেন্ডে—যা স্বর্ণ মাছের মনোযোগের থেকেও কম। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই সংকট আরও প্রকট, যারা দৈনন্দিন জীবনে অধিকাংশ সময় কাটায় স্ক্রিনে। প্রশ্ন হলো, এই বিক্ষিপ্ত ও অস্থির মানসিক অবস্থায় কীভাবে নিজেকে কেন্দ্রীভূত করা যায়? কীভাবে মনের উপর কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়া যায়?
চিরন্তন ইবাদতের ভিতরে আধুনিক সমাধান
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেতে পারি সেই চিরন্তন ইবাদতে, যা মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর বান্দাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন—সালাত বা নামাজ। সালাত কেবল একটি আচার বা পূজা নয়, বরং এটি এক ধরণের মানসিক ও আধ্যাত্মিক সাধনা, যা মনের স্থিরতা, একাগ্রতা এবং আত্মসংযম গঠনে অসাধারণ ভূমিকা রাখে।
মুসলমানদের কাছে সালাত এমন এক অনুশীলন, যা দিনে পাঁচবার মানুষকে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান করে। প্রতিটি রাকাতে, প্রতিটি সিজদায়, প্রতিটি আয়াতে রয়েছে গভীর মনোযোগ ও অন্তর্মুখী হওয়ার আহ্বান। কুরআনের সূরা আনকাবূতের ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, "নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে।" এই বিরত রাখা কেবল কর্মে নয়, চিন্তাতেও। কারণ মন নিয়ন্ত্রণে থাকলেই তো কর্ম বিশুদ্ধ হয়।
সালাত: প্রকৃত মাইন্ডফুলনেস
আজকের বিশ্বে 'মাইন্ডফুলনেস' নামে এক ধরণের থেরাপি জনপ্রিয়তা পেয়েছে—যেখানে মানুষকে শেখানো হয় কীভাবে বর্তমান মুহূর্তে থাকা যায়, অতীত ও ভবিষ্যতের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কীভাবে মনকে স্থির করা যায়। কিন্তু একজন মুসলিম প্রতিদিন পাঁচবার যে সালাত আদায় করেন, তা-ই তো প্রকৃত মাইন্ডফুলনেস। সালাত হচ্ছে এমন এক প্রশিক্ষণ, যেখানে মনের সমস্ত বিচ্ছিন্নতা, দুশ্চিন্তা ও ক্লান্তিকে ছেঁটে ফেলে একমাত্র আল্লাহর স্মরণে মনকে নিবিষ্ট করা হয়।
আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, প্রার্থনা বা ধ্যানের সময় মানুষের মস্তিষ্কের prefrontal cortex (যা মনোযোগ, যুক্তিবোধ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র) সক্রিয় হয়ে ওঠে। মার্কিন নিউরোসায়েন্টিস্ট Andrew Newberg ও গবেষক Mark Robert Waldman তাঁদের গবেষণায় বলেন, "ধর্মীয় প্রার্থনা বা মেডিটেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে যে পরিবর্তন আসে, তা মনোযোগ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদে সহায়ক হয়।"
সালাতের মনোসংযোগ বাড়ানোর উপকারিতা
১. মানসিক প্রশান্তি ও ভারসাম্য: যারা নিয়মিত সালাত আদায় করেন, বিশেষ করে খুশু ও খুযু সহকারে, তাদের মধ্যে মানসিক প্রশান্তি লক্ষ করা যায়। তারা বলেন, সালাত যেন দিনের ব্যস্ততার মাঝেও একটি শান্তির আশ্রয়—যেখানে কয়েক মিনিটের নীরবতা মনকে পুনরায় সংগঠিত করে।
২. স্ট্রেস হ্রাস ও উদ্বেগ কমানো: সালাতে যখন মানুষ সেজদায় যায়, তখন এক ধরণের মানসিক মুক্তি অনুভব করে। এই সেজদা মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ায় এবং চিন্তার চাপ হ্রাস করে। বিভিন্ন ইসলামিক ও মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা আন্তরিকভাবে সালাত আদায় করেন, তাদের মধ্যে উদ্বেগ কম থাকে।
৩. ডিজিটাল ডিটক্স ও মনোসংযোগ পুনর্গঠন: আজকের ডিজিটাল যুগে আমাদের মন যেন সারাদিন এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে টানা-হেঁচড়ার মধ্যে থাকে। একটার পর একটা মেসেজ, ভিডিও, বিজ্ঞাপন, নোটিফিকেশন—সবকিছু মনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। সালাত এই সমস্ত বিক্ষিপ্ততাকে থামিয়ে এক ধরণের আত্মিক বিশ্রামের সুযোগ তৈরি করে। Cal Newport তাঁর আলোচিত বই Digital Minimalism–এ বলেন, "নিয়মিত নিরিবিলি সময় কাটানো ও আত্মনিমগ্ন চিন্তার চর্চা মনোযোগ গঠনে অপরিহার্য।" সালাত সেই নিরিবিলি সময়কেই নিয়মিতভাবে নিশ্চিত করে।
৪. শৃঙ্খলা ও রুটিন গঠনের প্রভাব: সালাত সময়মতো আদায়ের অভ্যাস আমাদের জীবনে এক ধরণের শৃঙ্খলা আনে। এই শৃঙ্খলাবোধ শুধুমাত্র ইবাদতে সীমাবদ্ধ না থেকে কাজ, অধ্যয়ন, পরিবার বা সমাজজীবনেও প্রভাব ফেলে। নিয়মিত সময় অনুযায়ী সালাত আদায়কারীরা স্বাভাবিকভাবেই সময়ের মূল্য বোঝেন এবং মনোযোগী থাকেন।
গর্ভবতী নারীদের জন্য মানসিক প্রশান্তির উৎস
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী নারীরা যদি নিয়মিত সালাত আদায় করেন, তবে তাদের মধ্যে মানসিক চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। গর্ভাবস্থায় মানসিক প্রশান্তি শুধু মায়ের নয়, অনাগত শিশুর জন্যও জরুরি। সালাত এই প্রশান্তির উৎস হিসেবে কাজ করে থাকে।
তরুণ প্রজন্মের জন্য সালাতের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে তরুণ সমাজ সবচেয়ে বেশি ভুগছে মনোযোগের অভাবে। অনলাইন ক্লাস, সোশ্যাল মিডিয়া, গেমিং, ওয়ার্ক প্রেসার—সব মিলে তাদের মন যেন কোনো এক কেন্দ্রে থামতেই চায় না। এই তরুণদের জীবনে যদি সালাতকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে তা হবে এক আশীর্বাদস্বরূপ অভ্যাস। এটি তাদের জন্য শুধু আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শন নয়, বরং মানসিক ফোকাস বৃদ্ধির কার্যকর চর্চাও।
সালাত মানেই মনোযোগের প্রশিক্ষণ
সালাত হচ্ছে এমন এক অভ্যাস, যা মানুষকে দৈনিক জীবনের বিশৃঙ্খলা থেকে সাময়িকভাবে মুক্ত করে—একটি আত্মিক কেন্দ্রের দিকে ফিরিয়ে আনে। এটি আমাদের শেখায়, কীভাবে প্রতিদিন কয়েকবার নিজেকে এক নিরব জগতে স্থাপন করে সমস্ত বিক্ষিপ্ত চিন্তা থেকে নিজেকে আলাদা করা যায়।
মনোযোগের এই দুনিয়ায় প্রযুক্তি ও তথ্যের অতিপ্রবাহে যারা হারিয়ে যেতে বসেছেন, তাদের জন্য সালাত হতে পারে এক অন্তর্মুখী আত্মসংশোধনের মাধ্যম—যেখানে মনের প্রশান্তি, চিন্তার স্পষ্টতা এবং জীবনের ভারসাম্য আবারও ফিরে পাওয়া সম্ভব।
সালাত কেবল আখিরাতের মুক্তির উপায় নয়, বরং দুনিয়ার সবচেয়ে কার্যকর মনের চিকিৎসা ও মনোযোগ গঠনের কৌশল। এখন দরকার শুধু—এই সালাতকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে তার খুশু ও খুযুর সৌন্দর্যে নিজেকে আত্মনিয়োজিত করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ