
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে একটি অঘোষিত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক হয়রানি, চাঁদাবাজি, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং বিনিয়োগবিরোধী পরিবেশে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শিল্প খাত। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, পরিকল্পিতভাবে তাদের হয়রানি ও দমন-পীড়নের মধ্যে ফেলে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যকে। এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক দুর্যোগে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিভিন্ন খাতে শিল্প গড়ে তোলা দেশীয় উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, কোনো ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও বড় ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখা হচ্ছে মাসের পর মাস। বিনা নোটিশে তাদের দুদকে তলব করা হচ্ছে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা মামলাও দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় মব সৃষ্টির মাধ্যমে কিছু ব্যবসায়ীর বাড়ি ও অফিসে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাঁদাবাজরা প্রকাশ্যেই কোটি কোটি টাকা দাবি করছে, আর না দিলে ভয়ংকর হামলার হুমকি দিচ্ছে। এসব হামলার কারণে ব্যবসায়ীরা পরিবারসহ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যক্তি ও কোম্পানির শেয়ারকে টার্গেট করে একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে, যার প্রভাবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে পড়ে যাচ্ছে। এতে শুধু ব্যবসায়ীরা নন, বিপুল সংখ্যক সাধারণ বিনিয়োগকারীও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে শেয়ারবাজারে আস্থা আরও কমছে এবং নতুন বিনিয়োগকারী তৈরি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, এক বছরে দেশে বেকার বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার। শুধু চলতি অর্থবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়কালে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৬৩ শতাংশে। বর্তমানে দেশের মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৩০ হাজার। রাজধানী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে বহু কারখানা আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। মালিকরা বলছেন, উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না, বাজারে চাহিদা কম, আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে শ্রমিকরাও আতঙ্কে আছে।
গত বুধবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)-এর আয়োজনে এক আলোচনায় শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। সভায় ডিসিসিআই সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, "বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য এমন এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, যা শুধু বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে না বরং বহু উদ্যোক্তার আত্মবিশ্বাস চিরতরে নষ্ট করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় কেউ আর নতুন কারখানা গড়তে চাচ্ছে না।"
তাসকিন আহমেদ আরও বলেন, "যে উদ্যোক্তারা চাকরি না করে দেশে শিল্প স্থাপন করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, তাদের যদি এভাবে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস পাবে না।"
অভ্যুত্থানের পর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এমনিতেই নাজুক অবস্থায় ছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে শুল্ক বাড়ানো, রেমিট্যান্সে অতিরিক্ত চাহিদা, স্থলপথে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সীমিত হওয়ায় চাপ আরও বেড়েছে। অথচ এই মুহূর্তে দেশীয় শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়া ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবর্তে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দিয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরম ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে। অনেক উদ্যোক্তা এই বৈষম্যমূলক নীতিকে 'জাতীয় আত্মঘাতী পদক্ষেপ' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) প্রবাহ কমেছে ২৬ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ সময়ের মধ্যে নিট এফডিআই ছিল ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা এবার কমে ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলারে নেমেছে।
একই সঙ্গে দেশি বিনিয়োগও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৮২ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৭.১৫ শতাংশ। এর আগে এমন নিম্নগতি ২০১৭ সালের পর আর দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য:
অধ্যাপক এম কে মুজেরি, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও মহাপরিচালক, বিআইডিএস:
"বর্তমানে যে পরিস্থিতি আমরা দেখছি, তা কোনোভাবেই একটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিমুখী রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী নয়। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি, মিথ্যা মামলা, চাঁদাবাজি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করে সংঘবদ্ধ হামলা — সব কিছুই একত্রে আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হয়েছে, তা বিনিয়োগ পরিবেশকে পুরোপুরি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।"
ড. সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম:
"সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা না থাকা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে না তোলা, এবং প্রশাসনিক নির্যাতন — এসব মিলে এক ভয়ংকর সংকট তৈরি হয়েছে। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো দরকার, নইলে অর্থনীতির উপর অচিরেই আরও বড় আঘাত আসবে।"
"সরকারের উচিত দেশে যারা প্রকৃত শিল্প গড়েছেন, তারা যেন নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা। যারা ব্যাংক লুট করেছেন, তারা এখনো বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর যারা প্রকৃতপক্ষে কর্মসংস্থান তৈরি করছেন তাদের প্রতিদিন আদালত, দুদক আর চাঁদাবাজদের ভয় নিয়ে থাকতে হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই সহনীয় নয়।"
বাংলাদেশ এখন এক গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের ওপর চালানো অঘোষিত চাপ ও নির্যাতন দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় শুধু শিল্প খাত নয়, পুরো দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে, যার খেসারত দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ