
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় বাজেট মানেই সংখ্যার অঙ্কচিত্র—এমন ভাবনা থেকে এবার বেরিয়ে আসতে চান সাধারণ মানুষ। রাজধানী থেকে মফস্বলের খেটে খাওয়া মানুষ চাইছেন, এমন একটি বাজেট, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে, আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনবে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রতি সরাসরি সাড়া দেবে।
এ বছর একটি বিশেষ বাস্তবতায় বাজেট আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবং কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়া ছাড়াই অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২ জুন নতুন অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট পেশ করবেন। এই প্রেক্ষাপটে নাগরিকদের প্রত্যাশা—এই বাজেট যেন বাস্তবভিত্তিক, গণমুখী ও অরাজনৈতিক হয়।
দাম নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব
একাধিক শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রধান চাওয়া—পণ্যের দাম যেন সহনীয় থাকে। রাজধানীর রামপুরার গৃহিণী ইসমত আরা বলেন, "প্রতি বছর বাজেট আসার পর নতুন করে চাল-ডাল-তেলসহ সব কিছুর দাম বাড়ে। আমাদের মতো সীমিত আয়ের মানুষদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এবার চাই এমন বাজেট, যাতে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ে।"
রিকশাচালক আসলাম বলেন, "আমরা চাই এমন বাজেট যেখানে চাল, তেল, ডালের দাম কমে। প্রতিদিনের আয় দিয়ে সংসার চালানোই দায়।"
সরকার সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় সাত হাজার কোটি টাকা কম। বাজেটে ঘাটতি ধরা হতে পারে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। যার অর্ধেক আসবে বৈদেশিক উৎস থেকে, বাকিটা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হবে।
কর কাঠামোতে পরিবর্তনের দাবি
বেসরকারি চাকরিজীবী খায়রুল আলম বলেন, "মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। বাজারে গিয়ে তার প্রভাব স্পষ্ট। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো এবং নিত্যপণ্যের ওপর কর না বাড়ানো উচিত।"
একই দাবির পুনরাবৃত্তি করেন এক বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। তার মতে, "রাজনৈতিক প্রকল্প না নিয়ে এবার সরকারকে একটি ঐতিহাসিক বাজেট দিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের চাহিদার প্রতিফলন থাকবে।"
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুণগত বরাদ্দ চায় দেশবাসী
ঝিনাইদহের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, "শুধু বই দিলেই শিক্ষা হয় না। গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টয়লেট, শিক্ষকসংকট ও ডিজিটাল ক্লাসরুমের দিকে নজর দেওয়া দরকার।"
অন্যদিকে, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রাজধানীর কর্মজীবী ইসমাইল হোসেন বলেন, "সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওষুধ মেলে না। বাজেটে দরকার ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো উন্নয়ন।"
তরুণদের কর্মসংস্থান ও স্টার্টআপ সহায়তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, "তরুণদের জন্য বাজেটে স্টার্টআপ ফান্ড, প্রশিক্ষণ, কর ছাড় ও সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ রাখতে হবে। এই উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে।"
অপ্রদর্শিত অর্থে ছাড় নয়, নজর মূল্যস্ফীতিতে
অর্থ উপদেষ্টা এ বছর বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার কোনো সুযোগ রাখছেন না বলে জানা গেছে। এর পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হতে পারে ৫.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এপ্রিল ২০২৫ শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.১৭ শতাংশে। ফলে সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে।
সাধারণ মানুষের চাওয়া
সারসংক্ষেপে, দেশের নাগরিকরা একটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, মানবিক ও বাস্তববাদী বাজেট চান। যেখানে থাকবে— নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের দৃঢ় পদক্ষেপ, করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গুণগত বরাদ্দ, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সহায়তা, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা এবং সরকারি সেবা ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের প্রতি তাই প্রত্যাশা—এটি যেন শুধু আরেকটি বাজেট না হয়ে ওঠে, বরং হয়ে ওঠে দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি নতুন দিগন্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ