
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে, শনিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) নিয়মিত সভায় মোট ১১ হাজার ৮৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। দেশব্যাপী অবকাঠামো, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা আরও তরান্বিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং একনেকের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সভায় একনেক সদস্য হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৯ জন উপদেষ্টা অংশগ্রহণ করেন। পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে আয়োজিত এই সভায় শুধু উপদেষ্টারাই উপস্থিত ছিলেন, অন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা সচিবদের সভা চলাকালে প্রবেশাধিকার ছিল না।
মোট ব্যয়ের বিশ্লেষণ:
এই ৯টি প্রকল্পে মোট ১১,৮৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকার ব্যয়ের মধ্যে সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেবে ৮,০৪৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্য বা ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২,৯৮৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, এবং সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন থাকবে ৮১৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
অনুমোদিত প্রকল্পসমূহ:
একনেক সভায় অনুমোদিত ৯টি প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এই দুটি হলো:
আরবান ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রকল্প (UCRIP) – যা নগর এলাকার জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
প্রবৃদ্ধি: স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন (LED) প্রকল্প (প্রথম সংশোধিত) – এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতির শক্তিশালীকরণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় অনুমোদন পেয়েছে ৩টি বড় প্রকল্প:
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৮টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একাডেমিক ভবন নির্মাণ – যার মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষার পরিকাঠামো দৃঢ় হবে।
১৫টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্প – যা প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন প্রকল্প (তৃতীয় সংশোধিত) – ডিজিটাল শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে অনুমোদন পেয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প:
নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ উন্নয়নে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (অষ্টম পর্যায়) – যা শিশুকাল থেকেই নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে সহায়ক হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে:
গ্রিড পাওয়ার ইভাকুয়েশন সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট ফর ওজোপাডিকো – যা বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাকে উন্নত করবে।
পাওয়ার ট্রান্সমিশন স্ট্রেংথেনিং অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন অব রিনিউয়েবল এনার্জি – এই প্রকল্পের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে জাতীয় গ্রিডে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে অনুমোদন পেয়েছে একটি সামাজিক পুনর্বাসন প্রকল্প:
রিকভারি অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অব ইনফরমাল সেক্টর এমপ্লয়মেন্ট (রেইজ): রিইন্টিগ্রেশন অব রিটার্নিং মাইগ্রেন্টস (প্রথম সংশোধিত) – প্রবাস ফেরত কর্মীদের দক্ষতা ও কর্মসংস্থানে পুনঃএকত্রীকরণে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সময়সীমা বৃদ্ধি পাওয়া প্রকল্প:
সভায় ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার পুনঃনির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবও অনুমোদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, কারাগারের আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে এই প্রকল্প কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
পূর্বে অনুমোদিত প্রকল্প সম্পর্কে অবহিতকরণ:
সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা কর্তৃক ইতোমধ্যে অনুমোদিত ৪টি প্রকল্প সম্পর্কে একনেক সদস্যদের অবহিত করা হয়। এই প্রকল্পগুলো হলো:
কক্সবাজার জেলায় শুতলি ক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন (দ্বিতীয় সংশোধিত) – যা স্থানীয় শিল্প খাতের বৈচিত্র্য এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে।
সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালীকরণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) – প্রশাসনিক কার্যক্রমের ডিজিটাল রূপান্তর নিশ্চিত করবে।
বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) – এই প্রকল্প দেশের উত্তরাঞ্চলের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাকে সুসংহত করবে।
চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) – যা চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
এই ৯টি নতুন প্রকল্পের অনুমোদনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন খাতে টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম হবে। মানবসম্পদ উন্নয়ন থেকে শুরু করে জ্বালানি অবকাঠামো, কারিগরি শিক্ষা, জলবায়ু সহনশীল নগরায়ন ও প্রবাসী পুনর্বাসন—সবদিকেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে যেভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াগুলো এগিয়ে চলছে, তা আগামী দিনের উন্নয়নযাত্রার জন্য আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ