
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির ঘোষণা এবং সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এনবিআর এবং এর আওতাধীন সকল দপ্তরে। এক যুগান্তকারী আন্দোলনের অংশ হিসেবে আয়কর, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বিভাগের হাজারো কর্মকর্তা ও কর্মচারী ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে ২৪ মে (শনিবার) সকাল ৯টা থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করছেন। এই কর্মসূচি কেবল রাজধানী ঢাকাতেই নয়, সারাদেশব্যাপী কর, কাস্টমস ও ভ্যাট অফিসগুলোতে একইভাবে কার্যকর রয়েছে।
সকাল থেকেই আগারগাঁওয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের নিচে জড়ো হতে থাকেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্লোগান, ব্যানার ও ব্যাজ ধারণ করে তারা জানান দেন, এই কর্মসূচি পূর্ব পরিকল্পিত, যৌক্তিক এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত চলবে। তবে জনদুর্ভোগ কিছুটা হ্রাসের লক্ষ্যে রপ্তানি কার্যক্রম ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবাকে এই কর্মবিরতির আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।
চার দফা দাবির পেছনের প্রেক্ষাপট
আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে চারটি মূল দাবি:
‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির’ অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে।
রাজস্ব সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসম্মুখে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, সরকার ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর মাধ্যমে এনবিআরকে বিলুপ্ত করে এককভাবে নতুন কাঠামো তৈরি করতে চায়, যা প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে অগণতান্ত্রিক এবং স্বচ্ছতা ও দক্ষতার বদলে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এনবিআর বিলুপ্ত নয়, বরং এটি সংস্কার করে একটি আধুনিক, দক্ষ ও বিশেষায়িত সংস্থায় রূপান্তর করতেই তারা কাজ করছেন।
সরকারি আশ্বাসে আস্থাহীনতা
২২ মে রাতে অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, সব অংশীজন ও পরামর্শক কমিটির সাথে আলোচনার মাধ্যমে অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়াও এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনের জন্য উৎসাহিত করে তাদের আন্দোলন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
তবে এই বিবৃতিকে “স্বাগত” জানালেও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়, “যতক্ষণ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে অধ্যাদেশ বাতিল, চেয়ারম্যান অপসারণ এবং জনস্বার্থে পরামর্শ কমিটির সুপারিশ প্রকাশ না করা হবে, ততক্ষণ আন্দোলন চলবে।” পরিষদের নেতারা স্পষ্ট করে বলেন, সরকার শুরু থেকেই আন্তরিক হলে এই পর্যায়ে আসার প্রয়োজন হতো না।
কর্মসূচির ধাপ এবং আগামী পরিকল্পনা
বর্তমান কর্মসূচির আগে ১৩ মে এনবিআর চত্বরে অনুষ্ঠিত অবস্থান কর্মসূচি থেকে ১৪, ১৫, ১৭, ১৮ ও ১৯ মে কলম বিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। পরে ২০ মে আলোচনার আশ্বাসে কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু ২১ মে থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলন আবারও গতি পায়।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের মতে, এই কর্মসূচি হঠাৎ করেই আসেনি; এটি দীর্ঘ সময়ের অবজ্ঞা ও অব্যবস্থাপনার ফল। তারা দাবি করেন, “দেশ ও জনগণের কথা ভেবেই মাঝে মাঝে কর্মসূচিতে বিরতি দিয়েছি। কিন্তু সরকার অনড় মনোভাব নিয়ে আমাদের দাবিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় আমরা ধাপে ধাপে তীব্র কর্মসূচির পথে যেতে বাধ্য হয়েছি।”
ঘোষণা অনুযায়ী, ২৪ ও ২৫ মে পর্যন্ত কাস্টমস হাউস এবং এলসি স্টেশন বাদে সব অফিসে কর্মবিরতি চলবে। এরপর ২৬ মে থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা বাদে সকল দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি কার্যকর হবে।
সম্ভাব্য প্রভাব ও আশঙ্কা
রাজস্ব আদায়, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, ভ্যাট সংগ্রহসহ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতিপ্রবাহে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়বে তা নিশ্চিত। বেসরকারি খাত থেকে শুরু করে সরকারি বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতিপর্বে এমন কর্মবিরতি অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর বড় চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এনবিআরের এই অচলাবস্থা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে তা সরকারকে রাজস্ব ঘাটতিতে ফেলবে এবং বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি, বিনিয়োগ পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা হবে
আজ শনিবার (২৪ মে) বিকেল ৪টায় আন্দোলনকারীরা এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের অবস্থান ও পরবর্তী কর্মসূচি জানাবেন বলে জানিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। এই সম্মেলনে চার দফা দাবির বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরা হবে।
এদিকে, আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কঠোর অবস্থান বা বিকল্প সমাধানের আভাস মেলেনি। পরিস্থিতি দ্রুত সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং পারস্পরিক আলোচনার ওপরই নির্ভর করছে রাজস্ব বিভাগের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ও দেশের অর্থনৈতিক গতি।
বাংলাবার্তা/এসজে