
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশের জনগণের জন্য আসছে নতুন টাকার নোট। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করেছে, ঈদে বাজারে আসবে নতুন ডিজাইনের ১০০০, ৫০ ও ২০ টাকার নোট। তবে এবার এক ভিন্ন চমক থাকছে—এই নোটগুলোয় কোনো ব্যক্তির ছবি থাকছে না। এর পরিবর্তে উঠে আসবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর প্রতিচ্ছবি। এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
শনিবার (২৪ মে) সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) প্রধান কার্যালয়ে দেশের প্রথম “ক্রেডিট এনহ্যান্সমেন্ট স্কিম” উদ্বোধনকালে তিনি এসব তথ্য জানান। সেখানেই তিনি নতুন মুদ্রানীতির এই দিকটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
নতুন ডিজাইনের মুদ্রা: ঐতিহাসিক রূপান্তরের শুরু
গভর্নর জানান, নতুন নোটগুলোতে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ছবি থাকবে না। এ পরিবর্তন আসছে একটি বৃহৎ নীতিগত সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে। সরকারের সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন গত ডিসেম্বরেই সিদ্ধান্ত নেয় নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে আনার। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি মাসে টাঁকশালে নতুন মুদ্রা ছাপানো শুরু হয়।
এই নতুন মুদ্রার নকশায় থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য-সম্পদের প্রতিফলন। গভর্নর বলেন, “আমরা চাই জনগণকে তাদের ইতিহাসের সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত করতে। এই নোটগুলো প্রতিদিনের জীবনে তাদের স্মরণ করিয়ে দেবে নিজেদের গৌরবময় অতীতের কথা।”
বাংলাদেশ টাঁকশাল সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে ২০ টাকার নোট ছাপানো প্রায় সম্পন্ন। আগামী সপ্তাহে এই নোট বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে ৫০ এবং ১০০০ টাকার নোটও ছাপিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। টাঁকশাল কর্তৃপক্ষ জানায়, একসঙ্গে তিনটির বেশি নোট ছাপানোর সক্ষমতা নেই। তাই ধাপে ধাপে বাজারে ছাড়া হবে এই নতুন মুদ্রা।
নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে আনতে সাধারণত এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই নোট বাজারে আনতে কাজ করছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগে রাজনৈতিক অঙ্গীকার
শুধু নতুন টাকা ছাপানো নয়, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে সব প্রতিবেদন এসেছে, তা দেখে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার পথ অনেকটাই সহজ হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “আমরা এখন পর্যন্ত পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ ‘ফ্রিজ’ করতে সক্ষম হয়েছি। অর্থাৎ, ওই অর্থের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে প্রথম ধাপের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন সেটা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কূটনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়া চলমান।”
এই প্রচেষ্টাকে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবেই উল্লেখ করেন। “এটা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং নৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারও,” বলেন গভর্নর।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণে নতুন গ্যারান্টি স্কিম
এই দিনই দেশের প্রথম “ক্রেডিট এনহ্যান্সমেন্ট স্কিম” চালু করে পিকেএসএফ, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি সহজ করবে। গভর্নর বলেন, “এই স্কিমের আওতায় পিকেএসএফ অংশীদার এমএফআই গুলোকে ২৪০ কোটি টাকার রিজার্ভ ফান্ড থেকে ব্যাংক ঋণের গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এই গ্যারান্টি ভিত্তিতে ঋণের উপর মাত্র ০.৫ শতাংশ কমিশন ধার্য করা হবে।”
তিনি জানান, সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় এই পাইলট প্রকল্পে ইতোমধ্যেই পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
গভর্নর মনে করেন, এই ধরনের স্কিম ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকি মোকাবেলায় সাহায্য করবে এবং এর ফলে হাজারো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংকিং সেবা পেতে সক্ষম হবেন।
স্কুল পর্যায়ে আর্থিক শিক্ষায় গুরুত্বারোপ
এছাড়া আর্থিক স্বাক্ষরতা বাড়াতে গভর্নর দেশের সব ব্যাংককে প্রত্যেকটি স্কুলের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “শিশুদের স্কুল জীবন থেকেই আর্থিক জ্ঞান শেখানো জরুরি। এতে ভবিষ্যতে তারা একটি সুসংগঠিত অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠবে।”
এক নতুন যুগের ইঙ্গিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের উদ্ভাবনী পদক্ষেপ অর্থনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করছে। একদিকে ঐতিহাসিক স্থাপনার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়ের নতুন প্রকাশ ঘটছে, অন্যদিকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার মতো উদ্যোগ জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় গভীর প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছে।
অর্থনীতির গোড়ার দিক থেকে সাধারণ জনগণের জীবনধারায় ছুঁয়ে যাওয়া এই পরিবর্তনগুলো নতুন সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আর্থিক নীতির নতুন দিগন্তের বার্তা দিচ্ছে। সবমিলিয়ে, এই ঈদে বাজারে আসা নতুন টাকার নোট কেবল একটি নতুন মুদ্রা নয়, বরং তা হয়ে উঠতে পারে একটি নতুন দর্শনের প্রতীক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ