
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে জটিলতার চরম সীমায় পৌঁছেছে। গত কয়েকদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক উদ্বেগ, উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার ছায়া নেমে এসেছে। বিশেষ করে গত বুধবার সেনাপ্রধানের অফিসার্স অ্যাড্রেসে দেওয়া বক্তব্যের পর থেকে পরিস্থিতি তীব্র উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেনাপ্রধানের বক্তব্য যেন দেশের জনগণের প্রত্যাশার ও দুঃখের প্রতিধ্বনি হয়ে ধরা দেয়, যা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর চিন্তার জন্ম দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন বলে নানা গুজব ও সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, যা দেশে নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটায়।
এই গুজব ও তোলপাড়মূলক তথ্য ছড়িয়ে পড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রকমের অপপ্রচার চলতে থাকে। এমন একটি সময় বাংলাদেশ আর্মির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়, যেখানে বলা হয়, দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সশস্ত্র বাহিনীর লোগো ব্যবহার করে ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করছে। সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘আমরা এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না’, যা দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সতর্কবার্তা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
এই অস্থির পরিস্থিতিতে দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকরা একমত যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। তারা বলছেন, তিনি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন এবং সব কিছু বুঝেই দায়িত্ব পালন করা উচিত। পদত্যাগের মাধ্যমে সংকট আরও তীব্র হবে এবং দেশের জন্য সেটি কলঙ্কজনক হিসেবে বিবেচিত হবে। বরং সমস্যা নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জরুরি ও আন্তরিক সংলাপ শুরু করে সমঝোতার মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করাই একমাত্র সমাধান। এমনকি দেশের বিভিন্ন বিশিষ্ট নাগরিক বলছেন, সংকটের দায়িত্ব কার তা নির্ধারণ করে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া জরুরি।
রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা উনার পদত্যাগের দাবি করিনি। যদি তিনি নিজে দায়িত্বে অক্ষম হন, তাহলে রাষ্ট্র বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” অন্যদিকে, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মান-অভিমান করা গ্রহণযোগ্য নয়।”
অন্যদিকে, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “যেসব অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত করেছে, তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, “অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন না। তিনি দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। তবে পরিস্থিতি জটিল, রাজনৈতিক দলগুলোর ধৈর্য ধরতে হবে। রাজপথে অশান্তি ও অরাজকতা বন্ধ করতে হবে। সরকারের স্বচ্ছতা ও দ্রুত সংস্কার জরুরি।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, “বর্তমান সংকট আমাদের সবার ব্যর্থতার প্রতিফলন। দ্রুত মৌলিক সংস্কার এবং দ্রুত নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ প্রয়োজন। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করানো সম্ভব, তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার অবশ্যই করতে হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, “সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে কারণ সংস্কার কমিশন ও ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থা কমছে। সরকারকে নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হতে হবে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা নির্বাচন রোডম্যাপ চাই, পদত্যাগ নয়। ক্যাবিনেট ছোট করতে হবে, বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বদলাতে হবে।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। বিতর্কিত উপদেষ্টাদের অবিলম্বে অব্যাহতি দিতে হবে।”
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “ডিসেম্বরে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। সরকার দেরি করলে সংকট বাড়বে।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। ক্ষমতা যেন একক ব্যক্তির হাতে না থাকে। ঐক্যের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহবায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “সব পক্ষকে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। বর্তমান সরকারকে সফল করতে হবে এবং তাকে সময় দিতে হবে।”
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে তীব্র সংকট ও বিভ্রান্তি বিরাজ করছে, তা দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সহজে কাটিয়ে ওঠা কঠিন। দেশের স্বার্থে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সুদৃঢ় সংলাপ, দ্রুত মৌলিক সংস্কার, এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরার পথ তৈরি। সময় এখন আর ধৈর্যের নয়; সংকট নিরসন ও দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ