
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা এখন ভেঙে পড়ার পথে। এক সময়কার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামি এবং অভ্যুত্থানের পর গঠিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—এখন একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে জর্জরিত। তাদের বিভক্তি শুধু রাজনৈতিক মতপার্থক্য নয়, বরং নেতৃত্ব, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বেও রূপ নিয়েছে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের পথ হয়ে উঠেছে আরও দুরূহ ও অনিশ্চিত।
একাত্তর ও আদর্শিক মতপার্থক্য: জামায়াত-এনসিপির মুখোমুখি অবস্থান
গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেক্ষাপটে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত মতপার্থক্য হঠাৎ করেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একাত্তরবিরোধী বক্তব্যের বিরুদ্ধে এনসিপির ভিন্নতর অবস্থান নিবন্ধনবিহীন এই দুই দলের মধ্যকার সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে যদি একটি ঐতিহাসিক ইস্যু—মুক্তিযুদ্ধ—নিয়ে মতপার্থক্য থাকে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখা অসম্ভব।” এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ মাহমুদ বলেন, “একাত্তরের চেতনা গণতন্ত্রের ভিত্তি। আমরা যারা পরিবর্তনের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, তাদের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া অসম্ভব।”
বিএনপি-এনসিপি: নির্বাচন ঘিরে দ্বন্দ্বে উত্তাল
এনসিপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইলেও বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের পক্ষপাতী। এই মূল ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করছেন, এনসিপি আওয়ামী লীগ থেকে লোকজন দলে টানছে, আবার এনসিপি অভিযোগ করছে বিএনপি নেতারা নিজরাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে পুরোনো গ্যাম্বিটে ফিরে যেতে চাচ্ছে।
এনসিপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবুল হাশেম বলেন, “আমরা দেখছি বিএনপি শুধু গণতন্ত্র নয়, নিজেদের হারানো জায়গা ফিরে পেতে আগ্রহী। সেজন্যই তারা স্থানীয় নির্বাচনকে এড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের ভয়—তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পাবে।”
অন্যদিকে, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “আমরা জাতীয় নির্বাচন ছাড়া কোনো আলোচনায় আগ্রহী নই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র ফিরবে না। এনসিপি নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে আওয়ামী লীগের পুরোনো কৌশল নিচ্ছে।”
ইশরাক ইস্যু: অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক হোসেনকে বসানো নিয়েও তৈরি হয়েছে নতুন টানাপোড়েন। ইশরাকের ঘনিষ্ঠদের দাবি, এনসিপিপন্থী ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার চাপে তিনি এখনও শপথ নিতে পারছেন না। তাদের ভাষ্য, “দুই ছাত্র উপদেষ্টার ষড়যন্ত্রের কারণেই ইশরাক থেমে আছেন। আমরা অবিলম্বে তাদের পদত্যাগ চাই।”
উল্টো দিকে এনসিপির নেতারা অভিযোগ করছেন, “বিএনপিপন্থী আইন উপদেষ্টা ও আরও দুই উপদেষ্টা দলীয় স্বার্থে প্রশাসনকে কাজে লাগাচ্ছেন। তারা পুরো অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করছে।”
সংস্কার, রাখাইন, চট্টগ্রাম বন্দর: নীতি নিয়ে সংঘাত
নির্বাচন ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার প্রস্তাব এবং রাখাইনে মানবিক করিডর ইস্যুতে দুই দলের অবস্থান বিপরীতমুখী। এনসিপি এসব উদ্যোগকে বাস্তববাদী এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান হিসেবে তুলে ধরলেও বিএনপি এসবকে দেশের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ বলে দাবি করছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর হস্তান্তরের প্রস্তাব দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ। আমরা জনগণের অধিকার বিকিয়ে দিতে দেব না।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি: ঐক্য ছাড়া পথ নেই
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে গণঅভ্যুত্থানের সব অর্জন হারিয়ে যাবে। জনগণের মনে হতাশা জন্মাবে। জাতীয় ঐক্য ভেঙে গেলে দেশ বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে চলে যেতে পারে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, “গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ বা নব্বইয়ের আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা ক্ষমতার ভাগ চাননি। কিন্তু এখন আমরা দেখি, সবাই রাতারাতি কিছু পেতে চায়। ফলে নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে।”
সেনাপ্রধানের বার্তা: নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত
রাজনৈতিক জটিলতার এই প্রেক্ষাপটে আশাব্যঞ্জক বক্তব্য দিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, “২০২৬ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব দেখতে চাই।” বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন চাওয়ার দাবির সঙ্গে সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ঐক্যের অভাব গণতন্ত্রের জন্য হুমকি
সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু আলম শহিদ খান বলেন, “চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান মানুষকে আশা দিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা হতাশ। দলগুলো যদি নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে না পারে, তাহলে দেশের রাজনীতি আরও ভয়াবহ দিক নেবে।”
সুতরাং, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যকার বিভক্তি শুধু রাজনৈতিক রণকৌশলের ফাটল নয়, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তির ওপরই আঘাত। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে প্রয়োজন ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐক্য, পারস্পরিক আস্থা এবং জাতীয় স্বার্থে একযোগে কাজ করার সদিচ্ছা। অন্যথায়, ইতিহাস যেমন ক্ষমা করে না, জনগণও করবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ