
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকাতা-ভিত্তিক গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (GRSE) নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বহুল আলোচিত এক প্রতিরক্ষা ক্রয়চুক্তি বাতিল করেছে। এই চুক্তির আওতায় ২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ২৩৫ কোটি টাকা, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৮০ কোটি রুপি) মূল্যের একটি টাগ বোট নির্মাণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বিশেষ করে ভারতের কিছু সিদ্ধান্তের জবাবে এই চুক্তি থেকে সরে এসেছে ঢাকা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার মূলত ভারতের আচরণের প্রতি কৌশলগত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মূল প্রেক্ষাপট হলো ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহারে হঠাৎ করে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। গত শনিবার ভারত সরকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই তাদের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য রপ্তানি সামগ্রী পরিবহন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এটি বাংলাদেশি ব্যবসা ও সরবরাহ শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নৌবাহিনীর জন্য টাগ বোট কেনার ক্রয়াদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার অংশ। NDTV ও ইন্ডিয়া টুডে জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া না হলেও, GRSE কোম্পানি নিজেই ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে যে “বাংলাদেশ সরকার ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে।” এই ঘোষণার পর কোম্পানির শেয়ারমূল্যেও সাময়িক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সেভেন সিস্টার্স মন্তব্যে ভারত ক্ষুব্ধ
এই উত্তেজনার পেছনে আরও গভীর রাজনৈতিক-ভূরাজনৈতিক কারণও রয়েছে। ভারতীয় একাধিক সংবাদমাধ্যম বলছে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে "স্থলবেষ্টিত অঞ্চল" হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বাংলাদেশের ভূ-অবস্থানকে "সমুদ্রের একমাত্র প্রবেশদ্বার" হিসেবে উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে তিনি চীনের উদ্দেশে এই অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগ বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। ভারত এই মন্তব্যকে সরাসরি তাদের আঞ্চলিক স্বার্থে হস্তক্ষেপ ও কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখে।
বিশ্লেষকদের মতে, ড. ইউনূসের এই মন্তব্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ নীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। আর এ কারণেই ভারতীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান কিছু যৌথ প্রকল্পে মন্থরতা ও বাধা সৃষ্টি করতে শুরু করে — যার প্রতিফলন দেখা যায় সীমান্ত পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞায়।
চুক্তির পটভূমি ও ভাঙনের তাৎপর্য
২০২৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে GRSE-এর প্রতিনিধি দলের একটি বৈঠকের মাধ্যমে ৮০০ টন ওজনের টাগ বোট নির্মাণের এই চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। এটি ছিল ভারতের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ঋণের আওতায় বাংলাদেশের প্রথম বড় প্রকল্প। এই ঋণচুক্তি ছিল ঢাকা-নয়াদিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্কের এক বড় মাইলফলক, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে চূড়ান্ত করা হয়েছিল।
এই প্রতিরক্ষা ঋণের মাধ্যমে শুধু এই টাগ বোটই নয়, বরং বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভারতীয় তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে ভারত। এসব ঋণের একটি বড় অংশই খরচ হয়েছে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম, রেলপথ, সড়ক নির্মাণ ও বিদ্যুৎ প্রকল্পে।
তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি ভারতের জন্য এক কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শিল্প ঘাতক। GRSE-এর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যেসব উন্নয়নশীল দেশে ভারতের সফট পাওয়ার বৃদ্ধিতে অবদান রাখছিল, বাংলাদেশের মতো ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর সঙ্গে এমন একটি চুক্তি বাতিল সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রার উত্তেজনা
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই নানা মাত্রায় ওঠানামা করছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সেই সম্পর্ককে আরও স্পষ্টভাবে নয়া কৌশলগত মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চীন ও ভারত — উভয় শক্তিই বাংলাদেশকে নিজেদের প্রভাববলয়ে রাখতে চায়। একদিকে ভারতের প্রতিরক্ষা ঋণ, অন্যদিকে চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ ও সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রস্তাব — এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিকভাবে ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই পরিস্থিতিতে টাগ বোট চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত শুধু একটি একক প্রকল্প নয়; বরং এটি একটি বৃহৎ কূটনৈতিক বার্তা — যেখানে বাংলাদেশ বোঝাতে চেয়েছে যে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের কাছ থেকে একতরফাভাবে বাধা না দিয়ে পারস্পরিক স্বার্থে চালিত সম্পর্কই কাম্য।
বাংলাদেশের GRSE-এর সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল নিঃসন্দেহে দুই দেশের মধ্যে এক নতুন উত্তেজনার সূচনা করেছে। ভারতের পণ্য পরিবহন নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশের তার প্রতিক্রিয়ায় কৌশলগত প্রতিরক্ষা উদ্যোগ থেকে সরে আসা, উভয় দেশেই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে — যেখানে ভূরাজনীতি, প্রতিরক্ষা কৌশল এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা একে অপরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ