
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী বাজেটে প্রায় ১০০টি মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্কমুক্তির প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছে। এটি একটি বড় উদ্যোগ হিসেবে ধরা হচ্ছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্যের মার্কিন বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা কমানো হবে এবং আমদানিতে শুল্কের চাপ হ্রাস পাবে।
গত সোমবার এনবিআরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই নীতিনির্ধারণী প্রস্তাব অনুমোদন দেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, যদিও আইনগতভাবে দেশভিত্তিক পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্তির সুযোগ সীমিত, তবুও প্রায় ১৬১টি পণ্যের একটি প্রস্তাবিত তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যার অধিকাংশ পণ্যই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়।
এই তালিকায় রয়েছে তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি। উদাহরণস্বরূপ, তুলা, অব্যবহৃত তুলা, অপরিশোধিত ফ্লেক্স, টেক্সচারড পলিয়েস্টার সুতা, সিনথেটিক সুতা, কৃত্রিম ফিলামেন্ট টাও, সিনথেটিক স্টেপল ফাইবার এবং বিভিন্ন ধরনের টেক্সটাইল মেশিনারি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এছাড়াও তালিকায় সামরিক ও আইন-প্রয়োগকারী বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন টার্বোজেট, টার্বো প্রপেলার, বন্দুক, হাউইৎজার, মর্টার, রকেট লঞ্চার, গ্রেনেড লঞ্চার, স্ট্যান্ডার্ড-ইস্যু সামরিক অস্ত্র, মাজল-লোডিং আগ্নেয়াস্ত্র, টার্গেট-শুটিং শটগান ও রাইফেল। পাশাপাশি সরকারিভাবে আমদানি করা অন্যান্য সামরিক ও নিরাপত্তা সরঞ্জামও রয়েছে।
জ্বালানি, চিকিৎসা, কৃষি ও পোল্ট্রি খাতেও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এই তালিকায় রাখা হয়েছে।
গত ২ এপ্রিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জটিল করে তোলে। যদিও এক সপ্তাহের মধ্যেই ৯০ দিনের জন্য ওই শুল্ক আরোপ স্থগিত করা হয়, তারপরও ১৫ শতাংশ শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বর্তমানে রয়েছে। শুল্কের এই অতিরিক্ত বৃদ্ধি মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
বাণিজ্য ভারসাম্য উন্নয়নের পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের বিরূপ প্রভাব কমাতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ারকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ইতোমধ্যে ১৯০টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে এবং এখন সেই তালিকায় আরও ১০০টি পণ্য যুক্ত করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ২৭ হাজার ২৪৫ কোটি টাকার প্রায় সাড়ে চার লাখ টন পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে, যার ওপর ১০ থেকে ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত রয়েছে। এ থেকে সরকার ৫৯৫ কোটি টাকা শুল্ক আদায় করেছে।
বাণিজ্য ও অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা এনবিআরের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তারা বলেছেন, সফলতার জন্য শুল্কমুক্তির আওতায় এমন পণ্য রাখতে হবে যেগুলোর মার্কিন বাজারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। পণ্য আমদানি উল্লেখযোগ্য না হলে শুল্কমুক্তির সুবিধা কার্যকর হবে না। প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর বলেন, ‘শুল্ক ছাড় দিতে হবে এমন পণ্যের ওপর, যাদের প্রকৃত চাহিদা রয়েছে।’
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপরও একই ধরনের পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। তাই আমাদের উচিত এমন সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করা যাতে আমরা অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে সক্ষমতার মাত্র ৫২ থেকে ৫৪ শতাংশে পরিচালিত হচ্ছে। আমরা যদি এই সক্ষমতা ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে ইউরোপ ও মার্কিন বাজার অপরিহার্য। এই বাজার থেকেই বড় অর্ডার আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
তাদের আশা, এনবিআরের এই শুল্কমুক্তি উদ্যোগ তৈরি পোশাক খাতের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে।
এছাড়াও এনবিআরের পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২.৯১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, যার ওপর আমদানির শুল্ক ৩৫ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। এটি দেশের মোট শুল্ক ও কর রাজস্বের ২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকার মধ্যে ৬.১৫ শতাংশ অংশ। অন্যদিকে, একই সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮.৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার একটি বড় ছবি তুলে ধরে।
এর আগে বাংলাদেশ ১৯০টি মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করেছিল, আর এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেই তালিকায় আরও ১০০টি পণ্য যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন, যেখানে ভ্যাট ও শুল্ক ব্যবস্থার উন্নয়নসহ এই শুল্কমুক্তির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে। বাজেট বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনগত পরিবর্তন আনার প্রস্তুতিও চলছে।
সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উন্নয়নে শুল্কমুক্ত পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই বয়ে আনবে। এই উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা দেশীয় শিল্পকে বহুগুণে উৎসাহিত করবে, আমদানির ব্যয় কমাবে এবং বাংলাদেশের বাণিজ্যিক অবস্থানকে বিশ্বদরবারে আরও দৃঢ় করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ