
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের উদ্যোগকে ঘিরে দেশের সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদনের পর থেকেই সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি কর্মচারীরা এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন, শুরু করেন বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে নতুন কঠোর বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যা মূলত ১৯৭৯ সালের 'সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ'-এর বহু বিতর্কিত ধারা পুনরায় চালুর সুযোগ তৈরি করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তৈরি করা খসড়াটি বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
সংবিধানের ১৩৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারীকে শাস্তি দিতে হলে যথাযথ তদন্ত ও শুনানি প্রয়োজন। কিন্তু নতুন খসড়ায় এসব সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকেন বা সহকর্মীদের উসকানিমূলক আচরণে প্ররোচিত করেন—তবে তদন্ত ছাড়াই তাঁর বিরুদ্ধে তিন ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে: বরখাস্ত, চাকরি থেকে অব্যাহতি এবং পদাবনতি বা বেতন হ্রাস।
এছাড়া খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীরা এমন কিছু করতে পারবেন না যাতে অন্য কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়, অনানুগত্য সৃষ্টি হয়, বা দপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। এমনকি কারও প্রতি মৌখিক বা লিখিত অনুরোধেও যদি কারও কাজে অনুপস্থিতি দেখা যায়, তবে সেটিও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠন এই সংশোধনীর প্রতিবাদ জানিয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই কর্মচারীরা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ করেন। তারা অভিযোগ করেন, এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাভাবিক অধিকার ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে।
সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর ও মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ লিখিত বিবৃতিতে বলেন, “১৯৭৯ সালের বিশেষ অধ্যাদেশের ধারা সংযুক্ত করা হলে তা সংবিধান পরিপন্থি হবে। এতে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থায় সংকট তৈরি হবে।”
পরিষদের অপর অংশের সভাপতি নুরুল ইসলাম গতকাল এক জরুরি সভায় জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না করে গোপনে আইনটি পাশ করিয়েছে। “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও অগণতান্ত্রিক,” মন্তব্য করেন তিনি।
আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকেও এক কড়া বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “এই আইন হলে চিন্তার স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেকোনো সময় চাকরি হারানোর ভয় পাবেন। এতে করে প্রশাসনে আতঙ্ক ও অস্থিরতা তৈরি হবে।” সংগঠনের সমন্বয়ক মো. নজরুল ইসলাম নতুন খসড়া অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
এই খসড়া অধ্যাদেশের পেছনে রয়েছে সরকারি দপ্তরগুলোতে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়াস। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ গত মার্চে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানায়, “বর্তমানে অনেক কর্মচারী কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে বা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন, যা সরকারকে বিব্রত করছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে।” সেই চিঠির প্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর সঙ্গে ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশ যুক্ত করে কঠোর বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সরকারের সময় জারি করা অনেক অধ্যাদেশই বাতিল হয়ে যায়, যার মধ্যে ১৯৭৯ সালের এই অধ্যাদেশও ছিল। তবে ২০১৩ সালের ‘কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকরকরণ আইন’-এর মাধ্যমে কিছু অধ্যাদেশ আংশিকভাবে টিকিয়ে রাখা হয়। এবার সেই অধ্যাদেশই নতুন রূপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার।
সরকারি চাকরিজীবীদের সংগঠনগুলোর দাবি, অধ্যাদেশের প্রস্তাবিত ধারাগুলো সংবিধানের ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদেও সাংঘর্ষিক। কারণ, এগুলোর মাধ্যমে কর্মচারীদের ন্যায্য শুনানি ছাড়াই শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী।
সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দিয়েছে। তারা বলছে, এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে সরকারি প্রশাসন আরও দুর্নীতিপ্রবণ হবে এবং কর্তৃত্ববাদী মনোভাব তৈরি হবে।
সরকারি চাকরি আইনে এমন পরিবর্তন সত্যিই বড় ধরনের নীতিগত ও সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সরকার একদিকে বলছে, এটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে, অন্যদিকে কর্মচারীরা বলছে, এটি একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা নির্ভর করবে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং কর্মচারী সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়ার ওপর। তবে এটা স্পষ্ট, সরকারি প্রশাসনে একটি গভীর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যা দ্রুত সমাধান না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ