
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সরকারি দপ্তর ও সংস্থাগুলোতে প্রতিনিয়ত স্বাক্ষর জালিয়াতি, নকল নথিপত্র এবং ভুয়া অনুমোদন ব্যবহার করে অসংখ্য প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), শিক্ষা বোর্ড, পাসপোর্ট অফিস, এনআইডি কর্তৃপক্ষ, শিল্প মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারি হাসপাতাল—প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে প্রতারক চক্র নকল স্বাক্ষর ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে সুবিধা আদায় করছে। এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এবার সেই প্রযুক্তিগত পথেই জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার—ডিজিটাল স্বাক্ষর ব্যবস্থার মাধ্যমে।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত পাবলিক কী ইনফ্রাস্ট্রাকচার সামিট (PKI Summit)-2025 অনুষ্ঠানে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও তাৎপর্য তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার সরকারি কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট, সরকারি চিঠিপত্র, স্বাস্থ্যসেবা সনদ, শিল্প লাইসেন্স, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, এমনকি বিভিন্ন নিয়োগপত্রও ম্যানুয়ালি তৈরি ও যাচাই হচ্ছে। হাতে-কলমে যাচাই করতে গিয়ে জনবল সংকটের কারণে প্রকৃত যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জালিয়াতির সুযোগ তৈরি হচ্ছে।”
ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, “ডিজিটাল সিগনেচার বাধ্যতামূলক না হলে ভবিষ্যতে বিদেশি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় বা দূতাবাসগুলো বাংলাদেশের নথিপত্র ও সনদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। কারণ বিশ্ব এখন ব্লকচেইন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অটোমেশন ও স্বয়ংক্রিয় যাচাই প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ম্যানুয়াল কাগজপত্র যাচাইয়ের যুগ শেষ হয়ে এসেছে। বাংলাদেশকে এখনই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।”
ডিজিটাল স্বাক্ষর শুধুই একটি ‘ই-সাইন’ নয়—এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা কাঠামো যার ভিত্তি হলো পাবলিক কী ইনফ্রাস্ট্রাকচার (PKI)। এর মাধ্যমে প্রতিটি নথির সত্যতা যাচাই করা যায়, প্রতারণা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় এবং সাইবার আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়।
ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, “পিকেআই এমন একটি কাঠামো, যা একদিকে যেমন নির্ভরযোগ্যতা বাড়ায়, অন্যদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে সরকারি ডকুমেন্টে ডিজিটাল স্বাক্ষর যুক্ত থাকলে কেউ তা পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটাতে পারবে না। নথি যেখানে তৈরি হয়েছে, তা শনাক্তযোগ্য থাকবে।”
প্রযুক্তি খাতে সরকারের বড় বড় ঘোষণা সত্ত্বেও অনেক দপ্তরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এখনো ডিজিটাল স্বাক্ষর ব্যবহারে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না বলে জানান ফয়েজ তৈয়্যব। “অনেক সচিব, ডিজি বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাড়তি খরচের কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। অথচ এই খরচটাই দীর্ঘমেয়াদে ডিজিটাল অর্থনীতিতে আমাদের বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতারণা থেকে রক্ষা পেলে যে আস্থার পরিবেশ গড়ে উঠবে, তার কোনো মূল্যায়ন অর্থ দিয়ে করা সম্ভব নয়।”
তিনি আরও জানান, “আমরা ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে যাচাই করে ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছি। তারা খরচ কমিয়ে কীভাবে কার্যকরভাবে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে।”
সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন খাতে ডিজিটাল স্বাক্ষর ব্যবহারের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছে। প্রাথমিকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে এই প্রযুক্তি বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। এছাড়া ই-পারফরমেন্স, ই-নথি, ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকল দপ্তরকেই ডিজিটাল স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করার আওতায় আনা হবে।
ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, “সরকারি কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রযুক্তি খাতে পরিবর্তন আনতে হলে একক কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়, সকল স্টেকহোল্ডারকে একযোগে দায়িত্ব নিতে হবে।”
শেষে তিনি বলেন, “ডিজিটাল স্বাক্ষর শুধু একটি প্রযুক্তি নয়—এটি হচ্ছে প্রতারণা প্রতিরোধে ভবিষ্যতের আস্থা এবং সরকারি ব্যবস্থাপনার নতুন যুগের সূচনা। এখন প্রয়োজন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দৃঢ় অঙ্গীকার ও দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ। না হলে প্রতিদিনের নকল স্বাক্ষর, জাল কাগজ, এবং চুক্তির নামে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না।”
সারাংশে, ডিজিটাল স্বাক্ষর কেবল সাইবার নিরাপত্তার অবকাঠামো নয়, এটি একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার। এখন সময় প্রযুক্তির সঙ্গে যুগোপযোগী হওয়ার—না হলে প্রতারণা থামবে না, আস্থা ফিরবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ