
ছবি: সংগৃহীত
ভারতে বসবাসরত অনিবন্ধিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় গতি আনতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছে দিল্লি। বৃহস্পতিবার (২২ মে) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, অবৈধভাবে ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের তালিকা ঢাকা পাঠানো হয়েছে এবং এখনো পর্যন্ত অন্তত ২,৩৬০ জনের পরিচয় যাচাইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে নয়াদিল্লি। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে।
রনধীর জয়সওয়াল বলেন, “যেসব বিদেশি নাগরিক ভারতে অননুমোদিতভাবে বসবাস করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট—দেশের আইন অমান্যকারী কোনো বিদেশিকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন পাঠানো তালিকার ভিত্তিতে দ্রুত পরিচয় যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন করে। এই প্রক্রিয়া যত দ্রুত হবে, ততই ভালো।”
দিল্লির কূটনৈতিক চিঠি ও পরিচয় যাচাইয়ের অনুরোধ
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তালিকাভুক্ত ২,৩৬৯ জন বাংলাদেশি নাগরিকের নাম, ছবি, আঙুলের ছাপ এবং বিভিন্ন বায়োমেট্রিক তথ্যসহ একটি বিস্তারিত চিঠি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেই চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, যদি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে যে এসব ব্যক্তি বাংলাদেশি নাগরিক, তবে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু করা হবে।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাইয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে। তবে সরকারি পর্যায় থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
রাজ্যভিত্তিক অভিযানে বাংলাদেশের নাগরিকদের গ্রেপ্তার
গত কয়েক মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনিবন্ধিত বাংলাদেশিদের শনাক্ত করতে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এসব অভিযানে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বহু মানুষকে, যাদের অধিকাংশই সীমান্তবর্তী এলাকা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২১ মে উড়িশ্যার আইনমন্ত্রী পৃত্বিরাজ হরিচন্দন জানান, “রাজ্যজুড়ে অননুমোদিত বিদেশি অভিবাসীদের শনাক্তে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এসব বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করে কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এর মাত্র এক সপ্তাহ আগেই, ১৪ মে রাজস্থানের আইন ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী যোগারাম প্যাটেল এক বক্তব্যে জানান, রাজ্যে অন্তত এক হাজার সন্দেহভাজন বাংলাদেশি বসবাস করছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, এরা ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে স্থানীয়ভাবে কাজ করছে এবং কখনও কখনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে।”
আসামে চলছে ‘পুশ ব্যাক’ পদ্ধতি
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে এই সমস্যা সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ১০ মে ঘোষণা দেন, সীমান্তে নতুন কৌশল হিসেবে ‘পুশ ব্যাক’ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ হল—আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, “যেসব লোক বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আসামে প্রবেশ করেছে, তাদের কোনো রকম শুনানি ছাড়াই বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে আমরা আপস করব না।”
নিরাপত্তা উদ্বেগের পটভূমি
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সতর্ক করেছে। বিশেষ করে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে উদ্বেগ বাড়ছে, যেখানে অনুপ্রবেশকারীদের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড নিয়ে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগাম অঞ্চলে একটি সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনার পর, ভারত সরকার দেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত অনিবন্ধিত বিদেশিদের প্রতি আরও কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে।
ভারতের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাতে ট্রাইবুন ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিভিন্ন রাজ্যে যেসব বাংলাদেশি বৈধতা ছাড়াই বসবাস করছে, তাদের মধ্যে কিছু চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরা কখনও কখনও স্থানীয় অপরাধচক্রেও যুক্ত হচ্ছে।”
দিল্লির কূটনৈতিক চাপ এবং ঢাকার জবাব
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে কূটনৈতিক সমঝোতার পাশাপাশি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়াদিল্লির প্রত্যাশা, ঢাকা পরিচয় যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয় হবে।
তবে বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “বাংলাদেশ শুধু তখনই কাউকে ফেরত নেবে, যদি তার নাগরিকত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়। এর জন্য সময় ও সঠিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন।”
দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ
এই পরিস্থিতিকে দুই প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অনেক পর্যবেক্ষক। ভারত অবৈধ অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ঢাকা রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতরে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
দুই দেশের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সুষ্ঠু সমাধান না হলে, বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, এই সমস্যার সঙ্গে শুধু আইন বা কূটনীতি নয়, জড়িত রয়েছে মানবাধিকার, জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নও।
বাংলাবার্তা/এমএইচ