
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত শুক্রবার (২৩ মে) এক চরম উদ্বেগের কণ্ঠে জানান, ইসরাইল যে পরিমাণ মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে, তা কার্যত ‘এক চা চামচ’ পরিমাণের সমান। তিনি দাবি করেন, ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে সাহায্য সরবরাহে বিলম্ব করছে এবং নিরাপত্তার অজুহাতে কার্যত মানবিক সহায়তার প্রবেশ রোধ করছে। এর ফলে পুরো গাজা উপত্যকার জনসংখ্যা এখন দুর্ভিক্ষের তীব্র ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
আনাদোলু এজেন্সির খবরে জানানো হয়, নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গুতেরেস বলেন, “গাজার মানুষ এখনো প্রতিদিন ক্ষুধা, পিপাসা এবং জীবনের হুমকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে কাজ করছি। এই মুহূর্তে অনুমোদিত সব সাহায্য এক চা চামচের সমান। এটা মানবতার জন্য লজ্জাজনক।”
৪০০ ট্রাকের অনুমতি, পৌঁছেছে মাত্র ১১৫টি
মহাসচিবের তথ্যমতে, কেরেম শালোম ক্রসিং দিয়ে ৪০০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি পেলেও, মাত্র ১১৫টি ট্রাক থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন—ইসরাইলি পক্ষের জটিলতা, নিরাপত্তার নামে দেরি এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের অভাব।
গুতেরেস বলেন, “আমরা কিছু গমের আটা, শিশুদের পুষ্টিকর খাবার এবং ওষুধ বিতরণ করতে পেরেছি। দক্ষিণ ও মধ্য গাজার কিছু অংশে এখনো কিছু বেকারি কাজ করছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। উত্তর গাজায় এখনো একটিও ত্রাণ পৌঁছায়নি।”
একযোগে ভয়াবহ বোমাবর্ষণ, হাসপাতাল ব্যবস্থাও ধসে পড়ছে
এই মানবিক বিপর্যয়ের মাঝে গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৭৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। সবচেয়ে বেশি আঘাত হানা হয়েছে গাজার উত্তরাঞ্চলে, যেখানে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে গাজার হাসপাতাল ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, অবরুদ্ধ গাজায় মোট ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে মাত্র ১৯টি, যার মধ্যে সম্পূর্ণ কার্যকরভাবে কাজ করছে মাত্র ১২টি। যুদ্ধের তীব্রতার ফলে গত সপ্তাহেই চারটি প্রধান হাসপাতাল—ইন্দোনেশিয়া হাসপাতাল, ইউরোপিয়ান গাজা হাসপাতাল, কামাল আদন হাসপাতাল এবং হাম্মাদ হাসপাতাল—পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
জাতিসংঘ সরে যাচ্ছে মার্কিন-সমর্থিত বিতরণ প্রক্রিয়া থেকে
জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস এক স্পষ্ট বার্তায় জানান, তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত নতুন ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় অংশ নেবে না। কারণ এই বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হতে পারে এবং এতে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, “ত্রাণ সরবরাহে একটি বিশ্বাসযোগ্য, কার্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ দরকার, যা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”
ইউনিসেফ ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নড়াচড়া, তবু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল
মানবিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে ইউনিসেফ জানায়, তারা দক্ষিণ গাজার দেইর আল বালাহ অঞ্চলে ২০টি ট্রাকের সমপরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য গুদামে রেখেছে। পাশাপাশি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় কয়েকটি বন্ধ থাকা বেকারি আবারও চালু হয়েছে। দীর্ঘ দুই মাস পর আল-বান্না বেকারির মতো কিছু প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছে। তবে এই সহায়তা প্রয়োজনের এক ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।
গাজার ৪/৫ অঞ্চল ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ ঘোষণা, মানবতা যেন অবরুদ্ধ
গুতেরেস আরও জানান, গাজার মোট ভূখণ্ডের চার-পঞ্চমাংশ অঞ্চলই এখন সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য নিষিদ্ধ। এর ফলে ত্রাণ পৌঁছানোর পথ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। “এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে গাজায় আরও বহু মানুষ অনাহারে মারা যাবে,”—বলেন তিনি।
যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর অবরোধ
জাতিসংঘের প্রধানের এই বক্তব্য শুধু একটি মানবিক আর্তনাদ নয়, বরং বিশ্ব বিবেকের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা। গাজার মানুষ শুধু বোমার নিচে নয়, বরং ক্ষুধা, দাহ, ওষুধের অভাব এবং বিশ্ব রাজনীতির নিষ্ক্রিয়তার নিচেও পিষ্ট হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এই মানবিক দুর্যোগে দ্রুত, ন্যায়ভিত্তিক এবং নিরপেক্ষ হস্তক্ষেপ না করে, তবে আগামী দিনে গাজা নামের ভূখণ্ডটি হয়ে উঠবে এক বিশাল গণকবরে পরিণত।
গুতেরেসের এক কথায়, “আমরা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করছি—এখনো যা কিছু গাজায় ঢুকছে, তা এক চা চামচের সমান।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ