
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, অর্পিত দায়িত্ব পালনে যত প্রতিবন্ধকতাই আসুক না কেন, সেগুলো কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই হবে। দেশের ভবিষ্যৎ এই দায়িত্ব পালনের ওপর নির্ভর করছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
শনিবার (২৪ মে) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) নিয়মিত সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের একটি অনির্ধারিত ও রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য তুলে ধরেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও, উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস এতে সভাপতিত্ব করেন এবং উপস্থিত ১৯ জন উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তার এই বক্তব্যে উঠে আসে দায়িত্ববোধ, সংকট মোকাবিলার প্রত্যয় এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে চলমান সরকারের ভূমিকাকে ঘিরে এক উচ্চমাত্রার জাতীয় গুরুত্বের বার্তা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করেছেন—তিনি কোথাও যাচ্ছেন না। তিনি বলেননি যে তিনি দায়িত্ব ছাড়বেন বা সরে যাবেন। বরং তিনি বলেছেন, আমাদের যেসব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করা আমাদের কর্তব্য। এই দায়িত্ব পালনে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে—তা সত্য। কিন্তু সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমরা যে দায়িত্ব নিয়েছি, তা কোনো সাধারণ দায়িত্ব নয়। এর ওপর দেশের বহু বছরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সুতরাং এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে দেশের সামগ্রিক প্রশাসনিক পরিস্থিতি, চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, কর প্রশাসন পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একাধিক উপদেষ্টা বিভিন্ন দিক থেকে আসা প্রতিবন্ধকতা, যেমন রাজনৈতিক চাপ, আমলাতান্ত্রিক অসহযোগিতা, বিভাগীয় বিভাজন এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি—এসব বিষয় তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আমরা যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন থেকেই জানতাম—এটা মসৃণ পথ হবে না। কিন্তু দেশের জন্য আমাদের কিছু করতে হবে। অতীতের অন্যায়, দুর্নীতি, ভ্রান্তনীতি থেকে দেশকে বের করে আনতে হলে, এই কঠিন পথেই এগোতে হবে।”
বৈঠকে উপস্থিত একজন উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটা খুব স্পষ্ট বার্তা ছিল। ইউনূস সাহেব অনেক দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, আমরা কেউ দায়িত্ব এড়িয়ে যাব না। তিনি বলেছেন, জাতি যখন এত বড় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা পিছু হটতে পারি না।”
এর আগে শনিবার সকাল ১১টায় শুরু হওয়া একনেক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের আওতাধীন ১০টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিখাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
একনেক বৈঠক শেষে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে উপদেষ্টা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক শুরু হয় এবং তা চলে দুপুর ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত। সচরাচর একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ব্রিফ করে থাকেন, তবে আজকের বৈঠকে সেটি হয়নি।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে একনেক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, “আজ উপদেষ্টা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক থাকায় বাইরে কাউকে থাকতে দেওয়া হয়নি। এমনকি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পরিকল্পনা সচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও সভাকক্ষ ত্যাগ করতে বলা হয়।”
এই প্রসঙ্গে প্রশাসনিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আজকের এই বৈঠকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা গেছে—সরকারে দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টারা এখনও সংঘবদ্ধ এবং দায়িত্ব পালনে অটল। নানা ধরনের গুজব ও বিভ্রান্তির মাঝেও এই বার্তা জাতির জন্য আশ্বাসবহ।
বিশেষ করে কর প্রশাসন পুনর্গঠন ঘিরে উদ্ভূত সাম্প্রতিক উত্তেজনা, আইনজীবী ও পেশাজীবীদের আন্দোলন এবং কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অনাস্থার আবহে অনেকেই মনে করেছিলেন, হয়তো সরকার দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। তবে আজকের বৈঠকের পর সেই আশঙ্কা অনেকটাই দূর হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রেজা সিদ্দিকী বলেন, “এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হলো জনগণের আস্থা রক্ষা করা। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য জনগণকে বুঝিয়ে দেবে, এই সরকার দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে না এবং পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।”
আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিও এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের দিকে নিবদ্ধ। একাধিক রাষ্ট্রদূত ও উন্নয়ন সহযোগীরা একনেক বৈঠকের কার্যক্রম এবং সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করছেন।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সরকার যদি দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একটি গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে।
সবমিলিয়ে, শনিবারের বৈঠক থেকে প্রধান উপদেষ্টার যে বার্তা এসেছে—তা শুধু উপদেষ্টাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের আহ্বান নয়, বরং তা দেশের জনগণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ও নৈতিক বার্তা। তা হলো—দায়িত্ব শুরু করেছেন, শেষ না করে যাবেন না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ