
ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের প্রায় আট মাস পরেও যুদ্ধ বন্ধের কোনো ইঙ্গিত না থাকায় প্রশ্ন উঠেছে—এ যুদ্ধ আসলে কার স্বার্থে চলছে? সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য নিয়ে দেশটির জনগণের মধ্যে একটি বড় অংশের মধ্যে গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন মূলত নিজের রাজনৈতিক অবস্থান এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, যুদ্ধ জয়ের জন্য নয়।
শুক্রবার (২৩ মে) ইসরায়েলের প্রধান টেলিভিশন চ্যানেল চ্যানেল ১২-এ সম্প্রচারিত একটি জরিপে উঠে আসে এমন বিস্ফোরক মতামত। জরিপ অনুযায়ী, নেতানিয়াহুর যুদ্ধ পরিচালনার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য কী—এ প্রশ্নে উত্তরদাতাদের ৫৫ শতাংশ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকা। অন্যদিকে, ৩৬ শতাংশ মনে করেন তার লক্ষ্য হচ্ছে হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করা, আর বাকি ৯ শতাংশ উত্তরদাতা এই প্রশ্নে নির্দিষ্ট কোনো মত দিতে পারেননি।
এ জরিপটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দেশের মধ্যেই যেভাবে নেতানিয়াহুর কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে দেখা হচ্ছে, তা বর্তমান যুদ্ধনীতির নৈতিকতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু রাজনৈতিক মতবিরোধ নয়, বরং জনগণের মধ্যে গভীর হতাশা এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে জনজীবনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তা-ও প্রতিফলিত হচ্ছে এই জরিপে।
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার শুরু থেকেই গাজায় হামাস নির্মূল এবং জিম্মিদের উদ্ধারকে যুদ্ধের লক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া এবং জিম্মিদের সবাইকে মুক্ত করতে না পারার কারণে জনগণের এক বড় অংশ হতাশ হয়ে পড়েছে।
জরিপে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল—হামাসের হাতে আটক বাকি জিম্মিদের মুক্ত করতে ইসরায়েল নতুন কোনো চুক্তি করেনি কেন? এই প্রশ্নে ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারা বিশ্বাস করেন, নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে চুক্তির পথে এগোচ্ছেন না, কারণ তা তার রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে। অন্যদিকে ৩৮ শতাংশ বলেছেন, চুক্তি না হওয়ার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। ৯ শতাংশ বিষয়টি সম্পর্কে মত দিতে পারেননি।
এই প্রসঙ্গে অনেকেই মনে করছেন, যুদ্ধবিরতি এবং বন্দিমুক্তির ব্যাপারে আলোচনার ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর অবস্থান বরাবরই কঠোর। তবে এই কঠোরতার নেপথ্যে জাতীয় স্বার্থ না থেকে ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত রয়েছে বলেই বিশ্বাস করছেন অধিকাংশ ইসরায়েলি।
জরিপে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল—চলতি সপ্তাহে নেতানিয়াহু তার সংবাদ সম্মেলনে গাজা যুদ্ধের যৌক্তিকতা জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন কি না। ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তিনি জনগণকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ বলেছেন, তিনি বোঝাতে পেরেছেন, এবং ৪ শতাংশ নিশ্চিত নন।
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, নেতানিয়াহু যে ভাষণেই যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, তার প্রতি জনগণের আস্থা কমে এসেছে। বিশেষ করে যুদ্ধের নৈতিকতা এবং বাস্তব অগ্রগতি নিয়ে মানুষের সন্দেহ বেড়েছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর একটি প্রশ্ন ছিল নেতানিয়াহুর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। সম্প্রতি তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কাতারে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় অংশ নেওয়া ইসরায়েলি প্রতিনিধিদলের সর্বশেষ কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি অবগত নন। এই বক্তব্য জনগণের একাংশকে বিস্মিত করেছে।
জরিপ অনুযায়ী, ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা সরাসরি বলেছেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আস্থা রাখেন না। তাদের মতে, একজন দায়িত্বশীল রাষ্ট্রনেতা যুদ্ধবিরতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকতে পারেন না, বিশেষ করে যখন তিনি নিজেই যুদ্ধ পরিচালনার মূল দায়িত্বে থাকেন। ৩০ শতাংশ বলেছেন, তারা তার কথা বিশ্বাস করেন, আর ১২ শতাংশ এ নিয়ে নিশ্চিত নন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কেবল একটি নেতার জনপ্রিয়তা কমার ইঙ্গিত নয়, বরং একটি যুদ্ধরত রাষ্ট্রে জাতীয় ঐক্যের ভাঙনের চিত্র। যখন জনগণ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে যে সরকার তাদের সুরক্ষার বদলে নিজের ক্ষমতা রক্ষায় ব্যস্ত, তখন যুদ্ধের প্রকৃত নৈতিক ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অনেকেই এই জরিপকে কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহুর ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়াতে শুরু করেছে। তারা বলছে, জনগণের বিশ্বাস হারিয়ে একজন নেতার গাজা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া দেশ ও জাতির জন্য বিপজ্জনক।
বিশ্বজুড়ে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা নিয়ে তীব্র নিন্দা চলছে, তখন নিজের দেশের জনগণই যদি নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে, তবে সেটি তার আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে।
এই জরিপ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে, ইসরায়েলের একটি বড় অংশ মনে করে গাজা যুদ্ধ আজ আর শুধু সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই নয়, বরং এক ব্যক্তির রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
সূত্র: টাইমস অব ইসরায়েল
বাংলাবার্তা/এমএইচ