
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর লাগাতার বিমান হামলায় আবারও রক্তে রঞ্জিত হলো একদিন। গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৭৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শনিবার (২৪ মে) আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, কারণ ইসরাইলি বাহিনীর টানা বোমাবর্ষণ এখনো থামেনি।
এই হামলার সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে জাবালিয়া শরণার্থী শিবির থেকে, যেখানে একটি পরিবারের বাড়িতে চালানো ইসরাইলি বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে অন্তত ৫০ জনের মৃত্যু অথবা নিখোঁজ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতের আঁধারে হঠাৎ আকাশভর্তি যুদ্ধবিমান থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে, গোটা এলাকা একবারে কেঁপে ওঠে। স্থানীয় একজন বলেন, “আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। যখন ছুটে গেলাম, দেখি পুরো ভবনটাই আর নেই। শিশুদের মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ চোখ খুলেই মৃত।”
আরেকজন বৃদ্ধ ফিলিস্তিনি বলেন, “ইসরাইল যেন খেলার ছলে মানুষ মারছে। তারা জানে এখানে বেসামরিকরা রয়েছে, অথচ তাতেও হামলা থামছে না।”
এই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক মহলে ‘মানবতার চরম অবনমন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “গাজা সংকট এর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও অমানবিক অধ্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষ এখন একফোঁটা সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে কোনো ত্রাণ পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না, আর পুরো উপত্যকায় মাত্র এক চামচ পরিমাণ সহায়তা ঢুকছে প্রতিদিন। এটি কল্পনাতীত বর্বরতা।”
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে চলমান ইসরাইলি সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত মোট নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৫৩ হাজার ৮২২ জনে। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ২২ হাজার ৩৮২ জন।
তবে গাজার সরকার-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম অফিস এই সংখ্যাকে আরও বেশি বলে উল্লেখ করেছে। তাদের দাবি, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৬১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। অফিসটির মুখপাত্র জানান, বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন, যাদের জীবিত উদ্ধারের আশা নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে ইসরাইলের দাবি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে পরিচালিত এক হামলায় ইসরাইলে অন্তত ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং প্রায় ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ নীতি নিয়ে আক্রমণাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে, যার ফলে পুরো গাজা উপত্যকা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইল এ পর্যন্ত যতগুলো অপারেশন চালিয়েছে, তার মধ্যে এবারের অভিযান সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এবং সবচেয়ে অমানবিক। বেসামরিক লোকজন, বিশেষ করে নারী ও শিশু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এক মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় এখন প্রতিদিন গড়ে ২৫০টি করে বোমা ফেলা হচ্ছে। শিশু হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম, আশ্রয়কেন্দ্র—সবই হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘ, ওআইসি, আরব লীগসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন একের পর এক বিবৃতি দিলেও হামলা থামানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
গাজার এক মা, যার দুই সন্তান নিহত হয়েছে, চোখের পানি ধরে রাখতে না পেরে বলেন, “আমরা আর কীভাবে প্রমাণ করব যে আমরাও মানুষ? আমাদের বাঁচার অধিকার নেই?”
বিশ্ব যখন মানবতা, আইন, অধিকার নিয়ে সভা-সেমিনারে মশগুল, গাজার মানুষ তখন ধ্বংসস্তূপে আত্মীয়ের হাত খুঁজছে।
গুতেরেসসহ অনেকেই এই যুদ্ধকে ‘মানব সভ্যতার লজ্জা’ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু এখনও কোনো বড় পরিসরের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসেনি।
এই প্রতিবেদনের লেখা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত গাজার আকাশে যুদ্ধবিমানের গর্জন থামেনি, ধ্বংসস্তূপে লাশ উদ্ধার থামেনি, শিশুদের কান্না থামেনি।
মানবতা, হয়তো এই মুহূর্তে, সবচেয়ে বেশি কাঁদছে গাজা উপত্যকায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ