
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতিতে বহুল আলোচিত ডলার সংকট কাটিয়ে অবশেষে স্বস্তির হাওয়া বইছে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেছে, ব্যাংকগুলোতে আগের মতো ডলারের টানাপোড়েন আর নেই। বরং এখন বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই বাজার থেকে ডলার কিনছে, যা বৈদেশিক বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়ীদের আর অতিরিক্ত দামে ডলার কিনে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে হচ্ছে না, ফলে আমদানি কার্যক্রম অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২২ মে পর্যন্ত দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৩ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। আইএমএফের নির্দেশিত হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুসারে এ রিজার্ভের পরিমাণ ২০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক দায় বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ নির্ধারণ করা হয়।
গত কয়েক মাস ধরেই ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে চলেছে, যা রিজার্ভ বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। চলতি মে মাসের প্রথম ১৭ দিনেই এসেছে ১৬১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স। এপ্রিলে এসেছিল ২৭৫ কোটি ২০ লাখ ডলার, আর তার আগের মাস মার্চে এসেছিল রেকর্ড ৩২৮ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার, যা দেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত (৭ মে পর্যন্ত) মোট ২৫ হাজার ২৭৩ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এটি দেশের ইতিহাসে কোনো অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স গ্রহণের রেকর্ড। পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫৫৩ মিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের এ ঊর্ধ্বগতি রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছে।
প্রবাসী আয়ের এ প্রবাহ প্রতি মাসেই ছিল উল্লেখযোগ্য। যেমন—
-
জুলাইয়ে এসেছে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার
-
আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার
-
সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ডলার
-
অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার
-
নভেম্বরে ২২০ কোটি ডলার
-
ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি ডলার
-
জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি ডলার
-
ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩ কোটি ডলার
এই ধারাবাহিকতায় দেশে ডলারের ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হয়ে গেছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে ডলারের লেনদেন স্বাভাবিক হয়েছে। ব্যাংক টু ব্যাংক লেনদেনে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে গড়ে ১২২ টাকায়। ব্যাংকগুলো কিনছে ১২১ টাকায়, আর বিক্রি করছে ১২২ টাকায়। ব্যাংকবহির্ভূত লেনদেনে কোনো কোনো ব্যাংক ১২৩-১২৪ টাকায় বিক্রি করলেও সেটি সীমিত। খোলা বাজারেও (কার্ব মার্কেট) ডলার ১২৫ থেকে ১২৬ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে, তবে আগের তুলনায় চাহিদা অনেক কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক মাস ধরেই এ দর স্থির রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর এ পরিস্থিতিকে ইতিবাচক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগামী জুনেই ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা করছি। দীর্ঘমেয়াদে এটি ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।” এ লক্ষ্যে ব্যাংকিং খাতকে আরও শক্তিশালী করা ও সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো বিশেষভাবে কার্যকর হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি ডলার বিক্রি কমিয়ে এখন ধীরে ধীরে কিনতে শুরু করেছে, যার ফলে বাজারে প্রাকৃতিকভাবে ভারসাম্য ফিরে আসছে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি খাত, রেমিট্যান্স, এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলার ব্যবহারে আর কোনো বাধা থাকছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, হুন্ডি প্রতিরোধে কড়াকড়ি, এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রণোদনা অব্যাহত রাখা দরকার। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে আনার প্রক্রিয়াও জোরদার করা প্রয়োজন।
সার্বিকভাবে বলা যায়, ডলার বাজারে যে দীর্ঘদিনের অস্থিরতা ছিল, তা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এখন প্রয়োজন এই ইতিবাচক ধারাকে টিকিয়ে রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। দেশে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক এই বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা মধ্যম আয়ের লক্ষ্যের পথকে আরও প্রশস্ত করবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ