
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) একটি অপ্রতিরোধ্য সম্ভাবনাময় খাত। দেশের কর্মসংস্থান, আয়বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসে এসএমই খাত দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ এসএমই কোম্পানি রয়েছে এবং এই খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের—যা দেশের শিল্পখাতে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৭ শতাংশ। তবুও নীতিগত অনুকূলতা, অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতিতে এই বিশাল খাতটি তার কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে পারছে না।
অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা শেষ করে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, যাদের বড় একটি অংশই চাকরির অভাবে বেকার থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাজার, যা তিন মাস আগেও ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার। এই সময়ের মধ্যে বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার বেকার। এর মধ্যে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে ৪৭ জনই বেকার।
এসএমই খাতের উন্নয়নেই লুকিয়ে কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধান?
এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ২ লাখ ২০ হাজারও যদি উদ্যোক্তা হতে পারে, তাহলে দেশের বেকারত্ব পরিস্থিতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। অথচ দেশের জিডিপিতে এই খাতের অবদান এখনও মাত্র ৭.৩৫ শতাংশ (২০২১-২২ অর্থবছর অনুযায়ী)। তুলনামূলকভাবে পাকিস্তানে এই হার ৪০ শতাংশ, ভারতে ৩৭, শ্রীলঙ্কায় ৫২ এবং চীনে ৬০ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “এসএমই একটি শ্রমঘন শিল্প। এটি শুধু চাকরির ক্ষেত্র নয়, দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে এ খাতে বৈচিত্র্য ও উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। সরকারকে এই খাতে পলিসি সহায়তা এবং প্রণোদনা বাড়াতে হবে।”
‘লাভের ৩০ শতাংশ পুনঃবিনিয়োগ হয়’— এসএমইর প্রবৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের স্বকীয় ভূমিকা
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, “এসএমই খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে এসএমই খাতকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে উন্নয়ন করতে হবে। উদ্যোক্তারা তাদের আয় থেকে গড়ে ৩০ শতাংশ লাভ আবারো ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। এটি একটি চক্রাকার অর্থনৈতিক প্রবাহ তৈরি করে।”
সমস্যার তালিকা দীর্ঘ, কিন্তু সমাধান নেই তেমন
বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বলছেন, এসএমই খাতের বিকাশে মূলত পাঁচটি বড় সমস্যা রয়েছে—
১. অর্থায়নের অভাব
২. আধুনিক প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার
৩. অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা
৪. বাজারে চরম প্রতিযোগিতা
৫. ব্যবস্থাপনা দক্ষতার ঘাটতি
এছাড়াও কর কাঠামোর জটিলতা, লাইসেন্সিং ও নিবন্ধন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, নিরাপত্তাহীনতা ও চাঁদাবাজির মতো সমস্যাও উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে।
“ব্যাংক ঋণ দেয় না”— ছোট উদ্যোক্তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা
ঢাকার পোশাক খাতের উদ্যোক্তা কবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমি পাঁচ বছর আগে সীমিত পরিসরে আরকে ফ্যাশন নামে ব্যবসা শুরু করি। ব্যাংকগুলো আমাদের মতো নতুন উদ্যোক্তাদের মুখ দেখে ঋণ দিতে চায় না। উৎপাদন ঠিক থাকলেও বাজারজাতকরণে সমস্যা হয়। সরকার যদি কর ও লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ করতো এবং উপযুক্ত অবকাঠামো দিতো, তাহলে অনেকদূর এগিয়ে যেতাম।”
অর্থায়নের ঘাটতি: বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ, বাংলাদেশেও একই চিত্র
বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ফিনডেক্স ২০২১ অনুসারে, নারী-মালিকানাধীন আনুষ্ঠানিক এসএমইগুলোর জন্য বিশ্বজুড়ে তহবিল ঘাটতি ১.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে ২ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা সিএসএমই ঋণ বিতরণ করেছে, যা মোট ব্যাংক ঋণের মাত্র ১৯.১৪ শতাংশ।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করে যেখানে বলা হয়েছে, ২০২৯ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট ঋণের কমপক্ষে ২৭ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে দিতে হবে। তবে বাস্তবায়নের হার এখনও অত্যন্ত কম।
পলিসি সহায়তা ও বাজেটে বরাদ্দ ছাড়া এগোবে না খাত
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমান বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে ১৪০টি প্রস্তাব দিয়েছি আগামী বাজেটকে সামনে রেখে। নীতিগত সহায়তা এবং বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ ছাড়া এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমানে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রায় ২ লাখ উদ্যোক্তা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন এবং পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন প্রায় ২০ লাখ।”
তবে তিনি স্বীকার করেন, দেশের ১ কোটি ১৮ লাখ এসএমই উদ্যোগের তুলনায় এই সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই কম।
দেশি পণ্যে সম্ভাবনা, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনছে এসএমই
হস্তশিল্প, কৃষিভিত্তিক পণ্য, চামড়াজাত সামগ্রী, হালকা প্রকৌশল পণ্য ও ই-কমার্সের মাধ্যমে বাংলাদেশি এসএমই খাত ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে। প্রযুক্তির ব্যবহার, বিশেষ করে ডিজিটাল পেমেন্ট ও অনলাইন মার্কেটপ্লেসের ব্যবহার বাড়ছে। তবে এটিও এখনও সীমিত পর্যায়ে।
সমাধানে অর্থনীতিবিদদের সুপারিশ
১. সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ প্রণয়ন
২. নারী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ভর্তুকি বৃদ্ধি
৩. কর কাঠামো ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজীকরণ
৪. ই-কমার্স এবং আন্তর্জাতিক ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে প্রবেশে সহায়তা
৫. প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রশিক্ষণ ও গবেষণাভিত্তিক ক্লাস্টার উন্নয়ন
৬. দেশি-বিদেশি প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ
এসএমই খাত অবহেলার নয়, বরং সুযোগের ভাণ্ডার
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসএমই খাতকে পিছিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। এর শক্তিশালী মানবসম্পদ, উদ্যোক্তা মনোবৃত্তি এবং বৈচিত্র্যময় পণ্যের সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনীতি নতুন গতি পেতে পারে। সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সহযোগী এবং বেসরকারি খাত—সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই খাতের সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নেবে না।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন সমন্বিত, বাস্তবভিত্তিক ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ—যার মাধ্যমে এসএমই খাত দেশের জিডিপি, রপ্তানি এবং কর্মসংস্থানে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ