
ছবি: সংগৃহীত
ইসলামে কুরবানি শুধু একটি আনুষ্ঠানিক রেওয়াজ নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত—যার মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য পশু জবাই করে এবং ত্যাগের আদর্শে নিজেদের অন্তর পরিশুদ্ধ করে। কুরবানি যেমন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান, তেমনি এটি কবুল হওয়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, এই শর্তগুলো যথাযথভাবে না মানলে কুরবানি কবুল না হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কুরবানিকে শুধু সামাজিক উৎসব মনে না করে একজন সচেতন মুসলমান হিসেবে এর প্রতিটি দিক ও শর্ত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এই প্রতিবেদনে আমরা কুরবানি কবুল হওয়ার সাতটি মৌলিক শর্ত ও তা অনুসরণে করণীয় দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি, যা প্রত্যেক মুসলমানের জানা অপরিহার্য।
১. বিশুদ্ধ নিয়তই মূল ভিত্তি
ইসলামে নিয়ত বা অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য হল প্রতিটি ইবাদতের প্রাণ। কুরবানির ক্ষেত্রেও এটি ব্যতিক্রম নয়। যদি কারো কুরবানির উদ্দেশ্য হয় লোক দেখানো, সামাজিক সম্মান অর্জন, আত্মপ্রদর্শন বা শুধুমাত্র গোশত খাওয়া—তাহলে সেই কুরবানি ইসলামী দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
আল্লাহ বলেন: “এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়াই তাঁর কাছে পৌঁছে।” — (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)
সুতরাং কুরবানিকে ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজন একান্ত আন্তরিকতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদিত একনিষ্ঠ নিয়ত।
২. হালাল উপার্জনে ক্রয়কৃত পশুই গ্রহণযোগ্য
ইসলাম স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে—হারাম সম্পদ দিয়ে ক্রয়কৃত পশু দিয়ে কুরবানি করলে তা কবুল হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র জিনিসই কবুল করেন।” — (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩৯৩)
হারাম উপার্জন যেমন সুদ, ঘুষ, জালিয়াতি, মাদক ব্যবসা বা চুরি-ডাকাতির মতো অন্যায় পন্থায় অর্জিত সম্পদ দিয়ে যদি কেউ কুরবানি করে, তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি কোনো পশুতে যদি একাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে একজনের সম্পদ হারাম হয়, তবে পুরো কুরবানি বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই কুরবানি দেওয়ার পূর্বে নিজের সম্পদের হালালতা নিশ্চিত করা একজন মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব।
৩. পশুর ধরন: শুধুমাত্র নির্দিষ্ট প্রাণীই বৈধ
কুরবানির জন্য নির্ধারিত প্রাণীগুলোকে কুরআনে ‘বাহিমাতুল আনআম’ বলা হয়েছে। এদের অন্তর্ভুক্ত হলো—উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এর বাইরে কোনো প্রাণী—যেমন হরিণ, ঘোড়া, মুরগি, হাঁস ইত্যাদি দিয়ে কুরবানি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আল্লাহ বলেন: “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যেন তারা আল্লাহর প্রদত্ত চতুষ্পদ জন্তু জবাই করার সময় তাঁর নাম স্মরণ করে।” — (সুরা হজ, আয়াত: ৩৪)
৪. নির্দিষ্ট বয়স না হলে কুরবানি গ্রহণযোগ্য নয়
ইসলামে পশুর বয়স সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, “তোমরা মুসিন্না ব্যতীত পশু জবাই করো না।” — (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৬৩)
এখানে “মুসিন্না” বলতে বোঝায়—
উট: কমপক্ষে ৫ বছর
গরু ও মহিষ: কমপক্ষে ২ বছর
ছাগল: কমপক্ষে ১ বছর
ভেড়া ও দুম্বা: কমপক্ষে ১ বছর। তবে যদি ৬ মাস বয়সী দুম্বা বা ভেড়া এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে দেখতে এক বছর বয়সী মনে হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য।
এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বকরি কুরবানি করা যাবে না, যদিও সেটি অতিশয় হৃষ্টপুষ্ট হয়। এ নিয়ম আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান, যা পালনে অবহেলা করা চলবে না।
৫. পশু হতে হবে ত্রুটিমুক্ত ও সুস্থ
কুরবানির পশু সুস্থ, সবল এবং দৃষ্টিগোচর ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। পশুটি যদি অন্ধ, স্পষ্টত রোগাক্রান্ত, পঙ্গু, অত্যন্ত দুর্বল, অর্ধেক কান বা লেজ কাটা হয় অথবা মুখের অধিকাংশ দাঁত পড়ে যায়—তাহলে সেই পশু দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “চার ধরনের ত্রুটি যেসব পশুকে কুরবানির অযোগ্য করে তোলে—স্পষ্ট অন্ধ, স্পষ্ট রোগাক্রান্ত, স্পষ্ট খোঁড়া এবং এমন দুর্বল যে মজ্জাও থাকে না।” — (তিরমিজি, হাদিস: ১৪৯৭)
শরিয়তের দৃষ্টিতে এসব পশু কুরবানির জন্য অনুপযুক্ত। তাই পশু কেনার সময় এসব দিক খেয়াল না করলে ইবাদত মুলতবি হয়ে যেতে পারে।
৬. নির্ধারিত সময়েই কুরবানি করতে হবে
কুরবানির নির্দিষ্ট সময় ঈদুল আজহার নামাজের পর থেকে শুরু হয়ে চলে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এর আগে বা পরে কোনো পশু জবাই করলে তা কুরবানি হিসেবে গৃহীত হবে না।
হাদিসে আছে, “যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে পশু জবাই করল, তা তার পরিবারের জন্য গোশত হলো, কুরবানি হলো না।” — (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৬৫)
সুতরাং কেউ যদি ঈদের আগের দিন বা ফজরের আগেই পশু জবাই করে বসে, তাহলে সেটি ধর্মীয়ভাবে কুরবানি বলে গণ্য হবে না।
৭. জবাইয়ের পদ্ধতি ও শরিয়ত অনুযায়ী সম্পাদন
কুরবানির পশু জবাই করতে হবে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী। জবাইকারী মুসলমান হতে হবে এবং জবাইয়ের সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলা আবশ্যক। ধারালো ছুরি বা যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে যেন পশুর কষ্ট কম হয়। পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম, তবে কেউ চাইলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারে। এক্ষেত্রে কুরবানিদাতা পুরুষ হলে জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা উত্তম বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।
কেন এই শর্তগুলো জানা অত্যন্ত জরুরি?
ইবাদত যেমন কুরবানি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তেমনি তা যেন শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি ছোট ভুল বা অজ্ঞানতাবশত কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলেই সম্পূর্ণ কুরবানি বাতিল হয়ে যেতে পারে।
শর্তগুলো জানা ও মানা একজন মুসলমানের ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। এটি শুধু ইবাদতের শুদ্ধতা নিশ্চিত করে না, বরং একজন মুসলমানের আন্তরিকতা, দীনের প্রতি শ্রদ্ধা ও জীবনযাপনে শরিয়ত বাস্তবায়নের প্রমাণ বহন করে।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
১. কুরবানির আগেই শর্ত জেনে নিন
পশু কেনার আগে কুরবানির সব শর্ত ভালোভাবে পড়ে জেনে নিন। কোনো সন্দেহ থাকলে তা আলেমদের কাছে জিজ্ঞেস করুন। কারণ না জেনে করা ইবাদত অনেক সময় কবুল হয় না।
আল্লাহ বলেন, “বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে?”
— (সুরা জুমার, আয়াত: ৯)
২. দ্বিধায় থাকলে আলেমদের পরামর্শ নিন
আপনার কোনো দ্বিধা থাকলে অভিজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন হোন। আল্লাহ বলেন, “তোমরা জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো, যদি না জানো।”
— (সুরা নাহল, আয়াত: ৪৩)
কুরবানি শুধু পশু জবাই নয়—এটি একজন মুসলমানের ভেতরের তাকওয়া, ইখলাস ও ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ। এই মহান ইবাদত যেন বানচাল না হয়ে যায়, সে জন্য শর্তগুলো জানাও যেমন জরুরি, মানাও তেমনি অপরিহার্য। কুরবানির সময় এগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পালন করলে ইনশাআল্লাহ, আপনার কুরবানি কবুল হবে এবং আপনি পাবেন পরিপূর্ণ সওয়াব।
– প্রতিবেদনটি ইসলামি পণ্ডিতদের লেখা গ্রন্থ, হাদিস ও ফিকহ-ভিত্তিক প্রামাণ্য সূত্র অনুসরণে প্রস্তুত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ