
ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরের হজ মৌসুমকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের পবিত্রতম ধর্মীয় সমাবেশ নির্বিঘ্ন ও অত্যাধুনিকভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে সৌদি আরব সরকার ইতিহাসের অন্যতম বিস্তৃত ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। পবিত্র দুই মসজিদের (হারামাইন শরিফাইন) দায়িত্বে থাকা জেনারেল প্রেসিডেন্সি গত ১০ মে (শনিবার) আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪৪৬ হিজরি হজের জন্য এই পরিকল্পনার সূচনা করে। সৌদির রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গালফ নিউজ এ খবর নিশ্চিত করেছে।
স্মার্ট প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বহুভাষিক তথ্যসেবা ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের সমন্বয়ে গঠিত এই সুসংগঠিত পরিকল্পনায় মোট ১২০টি পৃথক উদ্যোগ এবং ১০টি অত্যাধুনিক ‘স্মার্ট ট্র্যাক’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো—বিশ্বের কোটি কোটি হজযাত্রীর জন্য একটি নিরাপদ, আধুনিক, আন্তরিক ও ধর্মীয়ভাবে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা।
জেনারেল প্রেসিডেন্সির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এবারকার হজ পরিকল্পনায় প্রযুক্তিনির্ভরতা সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। এ জন্য ১০টি বিশেষ স্মার্ট ট্র্যাক চালু করা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে—
ডিজিটাল ন্যাভিগেশন সিস্টেম,
বহুভাষিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক গাইডেন্স,
রিয়েল-টাইম তথ্য জানাতে সক্ষম ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট,
হজযাত্রীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উন্নতমানের স্যাটেলাইট মনিটরিং।
এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে হজযাত্রীরা তাদের রুট, রুটিন ও রিচুয়াল যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন এবং যেকোনো সমস্যা বা জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সেবাও পেতে পারবেন।
এই বিশাল কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে হজের সময় ২ হাজারেরও বেশি অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত সৌদি কর্মী মোতায়েন করা হবে। তাদের কাজ হবে—
হজযাত্রীদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা,
জরুরি অবস্থায় দ্রুত সাড়া দেওয়া,
হারামাইন এলাকায় ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা,
হজের মূল আনুষ্ঠানিকতাগুলোতে দিকনির্দেশনা ও সহায়তা প্রদান।
প্রেসিডেন্সির মুখপাত্র জানিয়েছেন, এই কর্মীরা নানা ভাষায় পারদর্শী এবং তাঁরা হজযাত্রীদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান জানিয়ে সেবা প্রদান করবেন।
হজ শুধু একটি আচারগত ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, বরং তা আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক চেতনারও এক বৃহৎ অনুষঙ্গ। তাই এ বছর ৫০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক ও বৌদ্ধিক কর্মসূচি চালু করা হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে হজযাত্রীদের মধ্যে ইসলামের গভীরতম বার্তা ও ইতিহাস তুলে ধরা হবে। এসব কর্মসূচিতে থাকবে—
ধর্মীয় বক্তৃতা ও ব্যাখ্যা,
কুরআন তাফসির,
নবীজীর (সা.) জীবনের শিক্ষা,
মানবিকতা, সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর আলোচনাসভা।
এই কর্মসূচিগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিচালিত হবে, যাতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত হজযাত্রী তাদের মাতৃভাষায় ইসলামের মৌলিক বার্তাগুলো বুঝতে পারেন।
সৌদি সরকার এবার হজের ‘মধ্যপন্থী ও সহনশীল ইসলামি বার্তা’ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সাতটি বিশেষ ট্র্যাক চালু করেছে। এই ট্র্যাকগুলোর মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিও, অ্যানিমেশন, সরাসরি সম্প্রচার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
মূল লক্ষ্য হলো হজকে এমন একটি আন্তর্জাতিক বার্তাবাহক বানানো—যেখান থেকে সারা দুনিয়ার মানুষ জানতে পারবে ইসলাম শান্তি, সহনশীলতা, সৌভ্রাতৃত্ব ও মানবতার ধর্ম।
এই কর্মপরিকল্পনা উদ্বোধনের সময় প্রেসিডেন্সির সভাপতি, প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও খতিব শেখ ড. আব্দুল রহমান আল সুদাইস বলেন, “সৌদি আরব সরকার পবিত্র দুই মসজিদের দর্শনার্থীদের জন্য তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত সম্পদ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল রূপান্তর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে আমরা এমন একটি হজ অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে চাই, যা হবে বিশ্বমানের এবং একইসঙ্গে ধর্মীয়ভাবে পরিপূর্ণ।” তিনি আরও যোগ করেন, “ভবিষ্যতের হজ এমন হবে, যেখানে প্রযুক্তি আর আধ্যাত্মিকতা একসূত্রে মিলবে।”
ড. সুদাইস জানান, ১৪৪৬ হিজরির হজ পরিচালনা পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে—দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য, ও ইসলামি আদর্শে গড়ে তোলা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সেবা।
এবারের হজ পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য, ট্রান্সপোর্ট, আবাসন, খাবার এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকেও আধুনিক করা হয়েছে। প্রতিটি পর্যায়ে আইওটি (Internet of Things) ডিভাইস ও ক্লাউডভিত্তিক নজরদারি থাকবে, যাতে কোনো ঝুঁকি দ্রুত শনাক্ত ও মোকাবিলা করা যায়।
এছাড়া শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী হজযাত্রীদের জন্য বিশেষ ট্র্যাক, হুইলচেয়ার সার্ভিস, ছায়াযুক্ত করিডোর এবং ‘রিস্টব্যান্ড ট্র্যাকিং’ ব্যবস্থাও চালু করা হচ্ছে।
সৌদি সরকারের এই নতুন পরিকল্পনা প্রমাণ করছে, পবিত্র হজ আজ শুধু একটি ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং বৈশ্বিকভাবে পরিচালিত এক জ্ঞান, প্রযুক্তি ও মানবিকতার সমন্বিত অনুশীলন। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি নিঃসন্দেহে এক আশাব্যঞ্জক বার্তা—যেখানে প্রযুক্তি ও ধর্মীয় অনুশাসন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ