ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর হাতে আবারও রক্তাক্ত হলো অসহায় মানুষের জীবন। গত ৪৮ ঘণ্টায় দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে ত্রাণ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এই বর্বর হামলায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৬২ জন। ফিলিস্তিনের কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো একে "জঘন্য অপরাধ" ও "মানবতা-বিরোধী আচরণ" হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত রাফা শহরের গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (Gaza Humanitarian Foundation – GHF) পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রকে ঘিরে। কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি যখন সেখানে জরুরি খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে জড়ো হন, তখনই ইসরাইলি বাহিনী তীব্রভাবে গুলি চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই হামলা চালানো হয়। এই ঘটনার একটি মর্মান্তিক ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে—ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের ওপর আকস্মিক গুলিবর্ষণের ফলে চারদিকে ছুটোছুটি ও আর্তনাদ।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে জানায়, এই হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং মানবিক সহায়তার পয়েন্টগুলোকে দখলদার বাহিনী মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ফিলিস্তিনিরা যখন বাঁচার আশায় ত্রাণ নিতে গিয়েছিলেন, তখন তাদের শরীর লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি চালানো হয়।”
হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান অন্তত ১০ জন। তাদের অধিকাংশই পুরুষ হলেও, কিছু নারী এবং কিশোরও গুরুতর আহতদের মধ্যে রয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। গুলিতে আহতদের অবস্থা আশঙ্কাজনক, ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে এই হামলার সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময় এখনও স্পষ্টভাবে জানাতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন, যদিও ধারণা করা হচ্ছে ২৭ বা ২৮ মে’র মধ্যবর্তী সময়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তা সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ (UNRWA)। সংস্থাটির প্রধান বলেছেন, “গাজায় মানবিক সহায়তার পথ রুদ্ধ করে রাখা এবং ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ বেসামরিক নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্যতম দৃষ্টান্ত।”
তিনি আরও বলেন, “ইসরাইলকে এখনই জাতিসংঘ-সমর্থিত মানবিক ব্যবস্থাগুলোকে কার্যকরভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে। নয়তো এটা সরাসরি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সামিল হবে।”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে শিশু ও নারী সংখ্যাগরিষ্ঠ। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি মানুষ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, আহতদের একটি বড় অংশ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের সহিংসতা নিছক যুদ্ধ নয়, বরং এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যার রূপ নিচ্ছে। ইসরাইল বিশ্বজনমত ও আন্তর্জাতিক চাপে গাজার রাফা সীমান্তে অভিযান ‘সীমিত’ রাখার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনতাসির কামাল বলেন, “ইসরাইল এখন গাজার জনগণকে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার—খাদ্য, পানি, ও চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত করছে। এটা একটি পরিকল্পিত ‘মানবিক অস্ত্র’ প্রয়োগের অংশ। ত্রাণ কেন্দ্রগুলোতে এইভাবে হামলা চালিয়ে ইসরাইল প্রমাণ করছে যে তারা গাজায় একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে চায়।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, “এটি সরাসরি যুদ্ধাপরাধ। কোনোভাবেই বেসামরিক ত্রাণপ্রত্যাশী জনগণকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো গ্রহণযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে এই হামলার তদন্ত শুরু করতে হবে।”
ব্রিটিশ মিডল ইস্ট পলিসি ফোরামের বিশ্লেষক অ্যাডাম ব্ল্যাকস্টোন বলেন, “ইসরাইল গাজার অবরোধকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে খাদ্য সংগ্রহ করাও এখন ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। এটা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ কৌশল—ক্ষুধার্ত মানুষকে জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টাতেও হত্যা করা হচ্ছে।”
গাজার বুকে আবারও রক্ত ঝরল, আবারও মৃত্যু হলো নিরস্ত্র মানুষদের। যাদের একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল—পেটের ক্ষুধা মেটাতে সামান্য কিছু ত্রাণ নেওয়ার চেষ্টা। আন্তর্জাতিক মহলের দায়িত্ব এখন আরও বড়। যদি এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও জবাবদিহির ব্যবস্থা না হয়, তবে মানবতার জন্য এটি ভয়াবহ নজির হয়ে থাকবে। গাজা শুধু আর একটি যুদ্ধক্ষেত্র নয়—এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



