
ছবি: সংগৃহীত
জিলহজ—আরবি বছরের শেষ মাস। হজ, কুরবানি ও তাকওয়ার অনন্য এক মাস। বছরের যে কয়টি সময় সবচেয়ে বেশি বরকতময়, ফজিলতপূর্ণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিক থেকে সর্বোত্তম, তার মধ্যে অন্যতম এই মাস। কিন্তু এই মাসের একটি বিশেষ দিক হলো—জিলহজের প্রথম দশ দিন। এই দশ দিন এমন একটি সময়, যাকে নিয়ে কোরআন ও হাদিসে এসেছে অসংখ্য ফজিলতের বর্ণনা, প্রশংসা এবং আমলের নির্দেশনা।
২৮ মে বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আকাশে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ফলে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে এই মর্যাদাপূর্ণ মাস। চাঁদ দেখা যাওয়ার অর্থ শুধু ঈদের দিন গণনা নয়, বরং ইমানদারদের জন্য এটি হলো আমলের দশটি দিন শুরু হওয়ার বার্তা।
কেন এই দশ দিন এত গুরুত্বপূর্ণ?
এই দশ দিন সম্পর্কে কোরআনে আল্লাহ তাআলা কসম খেয়েছেন। সূরা ফজরে বলা হয়েছে, “শপথ ফজরের, আর শপথ দশ রাতের।” (সূরা ফজর: ১-২)। বেশিরভাগ মুফাসসিরদের মতে, এখানে ‘দশ রাত’ বলতে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনকেই বোঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ কোনো কিছুর কসম তখনই খান, যখন তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়।
এছাড়া হাদিস শরিফেও এই দশকের ফজিলত অসাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে।
হাদিসে এ দশকের মর্যাদা
মুসনাদে আহমদে (হাদিস নং ১১৭৬২) প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন— “মনে রেখো! জিলহজ হলো সবচেয়ে সম্মানিত মাস।”
সহিহ বুখারিতে (হাদিস নং ৯৬৯) বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন— “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় দিন হলো জিলহজের প্রথম দশ দিন। এই দশ দিনে যে নেক আমল করা হয়, তা বছরের অন্য কোনো দিনে করা আমল থেকে বেশি প্রিয়।”
এই হাদিস শুনে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেন, “হে রাসুলুল্লাহ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও কি এই দশ দিনের আমলের চেয়ে প্রিয় নয়?” তিনি উত্তরে বলেন, “না, জিহাদও নয়। তবে সেই ব্যক্তি ব্যতিক্রম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে জিহাদে বেরিয়ে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।”
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, এই দশ দিনের আমলের মর্যাদা এমন উচ্চস্থানে যে, এমনকি জিহাদের মতো ইবাদতও এর সঙ্গে তুলনীয় নয়— যদি না কেউ নিজের জীবন উৎসর্গ করে ফেলে।
বছরের সেরা দিন বলে ঘোষণা
মুসনাদে বাযযারে (হাদিস নং ১১২৭) হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন— “সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দিনগুলো হলো জিলহজের প্রথম দশ দিন।”
এমন ঘোষণার পরও যদি একজন মুমিন এই সময়টিকে অবহেলা করে, তবে তা নিঃসন্দেহে পরকালীন পুঁজির বিরাট এক সুযোগ হারানোর নামান্তর।
এই দশকে কী আমল করবেন?
এই দশকে নফল নামাজ, তাসবিহ, কোরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা, জিকির, তওবা—সব কিছুতেই আলাদা ফজিলত রয়েছে। তবে যেসব আমল বিশেষভাবে হাদিসে গুরুত্ব পেয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—রোজা।
হযরত হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত (সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৪১৫)— “চারটি আমল নবীজি কখনো ছেড়েননি—আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, প্রতি মাসের তিনটি রোজা এবং ফজরের দুই রাকাআত সুন্নত।”
আরেক হাদিসে (মুসনাদে আহমদ: হাদিস ২২৩৩৪) বলা হয়েছে, “নবীজি জিলহজের প্রথম নয়টি দিন রোজা রাখতেন।”
ফলে যদি কারও পক্ষে সম্ভব হয়, তবে এই দশ দিনের মধ্যে প্রথম নয়টি দিন রোজা রাখা অত্যন্ত পুণ্যময়। দশম দিন ঈদের দিন হওয়ায় সেদিন রোজা রাখা হারাম।
কুরবানি ও আরাফার দিনের বিশেষ গুরুত্ব
জিলহজের দশ দিনের শেষাংশে আসে কুরবানির ঈদ। এই কুরবানিও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত, যা হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর আত্মত্যাগের অনন্য ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
আরাফার দিন, অর্থাৎ ৯ জিলহজ—হজ পালনের মূল দিন। যারা হজে যাচ্ছেন না, তাদের জন্য এই দিনে রোজা রাখা বিশেষ ফজিলতের কাজ। সহিহ হাদিসে এসেছে,
“আরাফার দিনের রোজা বিগত এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়।” (সহিহ মুসলিম)
জিলহজের গুরুত্ব উপলব্ধি কতটা?
আমরা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ‘সেরা’ খুঁজি—সেরা পোশাক, সেরা গাড়ি, সেরা পদ। কিন্তু বছরের যে দিনগুলোকে রাসুল (সা.) স্বয়ং ‘সেরা’ বলেছেন, তার জন্য আমরা কতটা উৎসাহী?
অথচ এই দশক এমন একটি সুযোগ—যেখানে অল্প আমলেও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব। জীবনের অন্য সময়গুলোতে যেখানে বড় বড় ত্যাগের প্রয়োজন হয়, এখানে হয়তো কয়েক রাকাত নফল নামাজ, কিছু সময় জিকির অথবা একটি রোজাই আমাদের আমলনামাকে পরিপূর্ণ করে দিতে পারে।
জিলহজের এই দশ দিন আল্লাহর বিশেষ রহমত ও বরকতের সময়। এ সময়কে অবহেলা করা মানে নিজের জন্য অপার সৌভাগ্যের দরজা বন্ধ করে দেওয়া। হাদিস ও কোরআনের আলোকে এই সময়টিকে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো আমাদের ঈমানদারিত্বের প্রমাণ।
আসুন, বছরের এই সেরা দশ দিনকে আমরা যেন না হারাই। পরকালীন পুঁজি সংগ্রহের এই সুবর্ণ সময়ে আমলে আমলে জীবনকে আলোকিত করি। জিলহজের প্রথম দশকে ছড়িয়ে পড়ুক আমলের সুবাস, জিকিরে মুখরিত হোক ঘর, মন, জীবন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ