
ছবি: সংগৃহীত
পবিত্র ইসলাম ধর্মের দুই মহামান্য নগরী—মক্কা ও মদিনা। মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের কেন্দ্রস্থল এই দুই শহর শুধু ভৌগোলিকভাবেই নয়, বরং আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিকভাবেও এক অসীম গুরুত্ব বহন করে। মক্কায় রয়েছে ইসলামের সর্বপ্রথম কিবলা, পবিত্র কাবা শরিফ, যেখানে প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমান হজ ও ওমরাহ পালন করতে আসেন। অপরদিকে মদিনায় অবস্থান করছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওজা মুবারক এবং মসজিদে নববি, যা মুসলিমদের জন্য অন্যতম পবিত্রতম স্থান।
এই পুণ্যভূমিগুলোতে মহান আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করাকে বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ মনে করা হয়। হজের সফর এমনই এক অসাধারণ ইবাদতের সুযোগ, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন সময় ও স্থানে দোয়া করেছেন এবং তাদের দোয়া সেখানে কবুল হয়েছে বলেই হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে। অতএব, মুসলিমরা যখন এই মহান ভূমিতে যান, তখন তারা যেন শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদতে নয়, বরং মনোযোগ ও বিনয়ের সাথে দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট চাওয়া-পাওয়া করে থাকেন।
হজ বা ওমরাহর সময় দোয়া কবুলের শুরুটা হয় ইহরামের নিয়ত করার মুহূর্ত থেকেই। একজন মুসলমান যখন নিয়ত করে হজের জন্য, তখনই তার অন্তর পরিশুদ্ধ হতে থাকে। সেই পরিশুদ্ধ অন্তর থেকেই বেরিয়ে আসে হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত দোয়া—যা আল্লাহর দরবারে দ্রুতই পৌঁছে যেতে পারে।
মক্কা শরিফের প্রতিটি ইঞ্চি ভূমিই পবিত্র এবং দোয়া কবুলের স্থান হিসেবে সম্মানিত। তবে রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম যে স্থানগুলোতে বিশেষভাবে দোয়া করতেন এবং যেসব জায়গা হাদিসে দোয়া কবুল হওয়ার স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব স্থানে দোয়া করা সুন্নত ও বাঞ্ছনীয়।
পবিত্র কাবা শরিফে তাওয়াফ করা, সাঈ করা, রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করা, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা—এইসব স্থান ও সময় কেবল আনুষ্ঠানিক হজের রীতিই নয়, বরং আধ্যাত্মিক আত্মনিবেদনের মুহূর্তও বটে। এসব সময়ে ও স্থানে দোয়ার প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।
মক্কার যেসব স্থানে দোয়া কবুল হওয়ার আশা প্রবল
১. কাবা শরিফের দিকে তাকিয়ে দোয়া করা
যখন একজন মুসলমান কাবা শরিফের দিকে তাকান, তখন তার অন্তরে যে আবেগ, ভক্তি ও আল্লাহর প্রতি যে ভয় জাগে, তা দোয়া কবুল হওয়ার এক অনন্য মুহূর্ত তৈরি করে। এটি এমন একটি সময়, যখন অন্তর গভীরভাবে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকে।
২. মাতাফ—তাওয়াফের জায়গা
মাতাফ হল কাবা শরিফের চারপাশে ঘোরার জায়গা, যেখানে হাজীরা সাতবার তাওয়াফ করে থাকেন। এই সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি হজ ও ওমরাহর অন্যতম ফরজ আমল এবং তাওয়াফের প্রতিটি চক্করে দোয়া করা উত্তম।
৩. মুলতাযাম
মুলতাযাম হচ্ছে কাবা শরিফের দরজা ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী অংশ। এখানে নবী করিম (সা.) নিজেও দোয়া করেছেন। এই স্থানে দুই হাত দিয়ে কাবা স্পর্শ করে বুক চেপে ধরে গভীর আবেগে দোয়া করার ফজিলত রয়েছে।
৪. মীযাবে রহমতের নিচে ও হাতীমের মধ্যে
হাতীম হলো কাবার অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা অংশ এবং এর মাঝে আছে মীযাবে রহমত, অর্থাৎ কাবা শরিফের ছাদের পানি বের হবার নালী। এখানে দাঁড়িয়ে বা সিজদায় গিয়ে দোয়া করলে তা আল্লাহ কবুল করে নেন বলে হাদিসে বর্ণিত।
৫. মাকামে ইবরাহীমের পেছনে
ইবরাহিম (আ.) যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে কাবা নির্মাণ করেছিলেন, সেটিই মাকামে ইবরাহীম। এই জায়গার পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় ও দোয়া করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
৬. সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের উপরে
হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সাঈ, যা সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দৌঁড়ানোর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এই দুই পাহাড়ের উপরে উঠেই হজরত হাজেরা (আ.)-এর স্মরণে দোয়া করা হয়, এবং এখানে দোয়া কবুলের আশ্বাসও রয়েছে।
৭. মাসআ—সাঈয়ের মাঝামাঝি স্থানে
সাঈর সময় দৌড়ানোর নির্দিষ্ট জায়গাটিকে মাসআ বলা হয়। বিশেষ করে ছেলেরা এই স্থানে হালকা দৌড় দেয়। এই সময়টিও দোয়ার জন্য বিশেষভাবে বরকতময়।
৮. রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থান
তাওয়াফের সময় রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা সুন্নত এবং রুকনে ইয়ামানী থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত রাসুল (সা.) দোয়া করতেন—“রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাহ...”
৯. মিনা—মসজিদ ও খোলা ময়দান
মিনায় অবস্থান করার সময় মসজিদগুলোতে ও খোলা ময়দানে দোয়া করা হয়। মিনার প্রতিটি মুহূর্ত হজের অংশ এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ।
১০. আরাফাতের ময়দান
হজের মূল রোকন হলো আরাফাতে অবস্থান। ৯ জিলহজ আরাফার দিন সেখানে অবস্থান করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেছেন, “আরাফার দিনের দোয়ার চেয়ে উত্তম কোনো দোয়া নেই।”
১১. মুযদালিফার ময়দান
আরাফাত থেকে ফেরার পর হাজীরা মুযদালিফায় অবস্থান করেন, যেখানে তারা মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে আদায় করেন এবং রাতে অবস্থান করেন। এখানেও আল্লাহর কাছে একান্তভাবে দোয়া করার সময়।
১২. জামারাত—শয়তানকে কংকর নিক্ষেপের স্থান
মিনায় জামারাত তিনটি পিলারের প্রতিকৃতির প্রতীক। হাজীরা এখানে কংকর নিক্ষেপের পাশাপাশি নিজের ভেতরের কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানি চিন্তাকে দূর করার মানসিকতা নিয়ে দোয়া করে থাকেন।
মক্কা শরিফে অবস্থান মানেই শুধুই একটি সফর নয়—এটি এক আত্মিক যাত্রা, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি দৃষ্টিতে আল্লাহর কৃপা লাভের সুযোগ রয়েছে। হজ বা ওমরাহ পালনের সময় মুসলমানরা যেন এই পবিত্র স্থানগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে সঠিক সময়ে এবং যথাযথ স্থানে দোয়া করার চেষ্টা করেন, সেটাই কাম্য। কেননা, এই সব স্থানে কৃত দোয়া শুধু ইহকালে নয়, পরকালেও হয়ে উঠতে পারে মুক্তির মাধ্যম।
বাংলাবার্তা/এমএইচ