
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত ছয় মাস মেয়াদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবার দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী সোমবার, ২ জুন, রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ সংলাপের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিকেল ৩টায় শুরু হতে যাওয়া এই সভায় প্রথম ধাপের সংলাপে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যদিও একই দিন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন উপলক্ষ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান একদিন পিছিয়ে যেতে পারে বলেও একটি সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বের সংলাপকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে আলোচনার ঝড় উঠেছে। বিশেষ করে বিএনপির অবস্থান ও মন্তব্যগুলো একে ঘিরে বিতর্ককে আরও শাণিত করেছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, ২ জুন তাদের আবারও ডাকা হয়েছে, তবে অংশগ্রহণ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, “আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” এক অনুষ্ঠান বক্তব্যে তিনি তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন থাকলেও কাজের খবর নেই।”
সালাহউদ্দিনের এই মন্তব্যের পেছনে রয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গত কয়েক মাসের কার্যক্রম, যা অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও বিএনপি তা একপাক্ষিক ও ফলশ্রুতিহীন বলেই মনে করছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিরোধী দলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদি “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন” গঠিত হয়। কমিশনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম ধাপের সংলাপ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংক্রান্ত ছয়টি কমিশনের মোট ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া এবং একটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করা।
কমিশনের তথ্যমতে, প্রথম পর্বে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে মতামত দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়, যাদের মধ্যে ৩৫টি দল থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৪৫টি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার সুবিধার্থে একাধিক দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করা হয়।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সংবিধান সংস্কার বিষয়ে ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন নিয়ে ২৬টি এবং দুদক সংস্কার বিষয়ে ২০টি সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্প্রেডশিট আকারে পাঠানো হয় এবং তাদের কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়। এর ফলে কিছু বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্য এবং কিছু বিষয়ে আংশিক ঐকমত্য গড়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত, আলোচনায় উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে:
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি
দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা ও কাঠামোগত সংস্কার
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা
নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক শক্তির প্রয়োগে সক্ষম করা
এই প্রস্তাবগুলোতে বহু দলের মধ্যে প্রাথমিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
কমিশনের সূত্রমতে, দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্দেশ্য হলো এই প্রাথমিক ঐকমত্যগুলো আরও সুস্পষ্ট করে একটি লিখিত চুক্তি তথা ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা, যেখানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ও স্বাক্ষর থাকবে। সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, “জুলাইয়ের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে বলেই আমরা আশাবাদী।” তবে তিনি এটিকে এখনো ‘ইচ্ছা’ বলে অভিহিত করেছেন, কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।
কমিশনের আরেক সদস্য এবং সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, “আশা করছি দ্বিতীয়বারের আলোচনায় আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। তার ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ হবে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।”
জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগকে ঘিরে যদিও সরকারি দলগুলোর পক্ষ থেকে আশাবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে, বিরোধী শিবির বিশেষ করে বিএনপির অবস্থান বেশ সংশয়ী ও সমালোচনামূলক।
শনিবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “প্রথম পর্যায়ে একবার উদ্বোধন করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আবার উদ্বোধন করবেন, তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে আবার করবেন। এভাবে কি আপনি আমাদের সংস্কারের কলা দেখাচ্ছেন?” তিনি এই প্রক্রিয়াকে অনর্থক আনুষ্ঠানিকতা বলে অভিহিত করেন।
তিনি আরও বলেন, “যে সংস্কারগুলো কমিশন নিজেদের মতো করে বানিয়েছে, তা জাতিকে মেনে নিতে বাধ্য করতে চায় – এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র?” তিনি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলকে সব অঙ্গের ওপর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব দেওয়ার ধারণাকে ‘বাকশালের দিকে ধাবিত হওয়া’ বলে কটাক্ষ করেন।
তার মতে, সরকারবিরোধী দলগুলোর মতামত থাকলেও কমিশন সেগুলো উপেক্ষা করে একতরফা পথে এগোচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার লেখা আকারে বলা হয়েছে, কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, কোন কোন বিষয়ে হয়নি, কিন্তু কমিশন তা এখনও জাতির সামনে আনেনি।
সংলাপ ও কমিশনের কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে এখন রাজনৈতিক মহলে দ্বিধা ও প্রত্যাশা উভয়ই রয়েছে। বিএনপি যেমন এটিকে প্রতারণামূলক বলছে, তেমনি কমিশনের অনেক সদস্য বলছেন, প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ হলেও তার ফল আসবে।
জুন মাসের দ্বিতীয় দফার আলোচনা শেষে জুলাইয়ের মধ্যে ‘জাতীয় সনদ’ প্রকাশ করার লক্ষ্যে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রশাসনিক সংস্কারে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে – যদি তা সকল দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হয়।
এখন দেখার বিষয়, বিএনপি এবং অন্যান্য সংশয়ী দলগুলো শেষ পর্যন্ত সংলাপে অংশ নেয় কি না এবং গ্রহণযোগ্য একটি চুক্তি প্রস্তুত হয় কি না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিগত সংস্কার অনেকাংশে এই সংলাপের সফলতার ওপরই নির্ভর করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ