
ছবি: সংগৃহীত
চার দিনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সফর শেষে দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৩১ মে শনিবার দিবাগত রাতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি। রাত ১২টা ১৫ মিনিটে তাঁর আগমনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় একটি বহুমাত্রিক, অর্জনসমৃদ্ধ ও কূটনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ সফর, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
জাপানের রাজধানী টোকিওর নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় ১১টা ২০ মিনিটে ঢাকা অভিমুখে রওনা দেন ড. ইউনূস। ফ্লাইটটি সিঙ্গাপুর হয়ে ঢাকায় অবতরণ করে। এই সফর শুরু হয়েছিল ২৮ মে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রায় ২০টি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি, বহু বৈঠক, চুক্তি, সেমিনার ও আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণ।
সফরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ড. ইউনূসের জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার (খবর অনুসারে 'ইশিবার') সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, যা অনুষ্ঠিত হয় সফরের তৃতীয় দিন, ৩০ মে শুক্রবার। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে চলতি বছরের মধ্যেই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (Economic Partnership Agreement - EPA) স্বাক্ষরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং শুল্ক ছাড়সহ অন্যান্য বিনিয়োগ সুবিধা জোরদার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাপানি প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশের বাজেট সহায়তা ও রেল যোগাযোগ উন্নয়নের জন্য ১.০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরই উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক (MoU):
ডেভেলপমেন্ট পলিসি লোন: ৪১৮ মিলিয়ন ডলারের এই ঋণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েল গেজ ডাবল লেন রেলপথ: ৬৪১ মিলিয়ন ডলার ঋণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই রেল প্রকল্পের উন্নয়নে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন বৃত্তি: ৪.২ মিলিয়ন ডলারের অনুদান প্রথা অনুযায়ী জাপান সরকার বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদান করবে।
একই দিনে টোকিওতে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’-এ প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা, রফতানি খাত, অবকাঠামো ও শিল্পায়নের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। সেমিনারে ছয়টি নতুন সমঝোতা স্মারকে সই হয়, যা মূলত বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর, ব্যবসা সহযোগিতা এবং যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করবে।
২৯ মে বৃহস্পতিবার জাপান ও বাংলাদেশ দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে, যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের দক্ষ মানবসম্পদের জাপানি শ্রমবাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করা। চুক্তির মাধ্যমে জাপানে বাংলাদেশের জনশক্তি নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে।
এই চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয় টোকিওর হিরাকাওচো চিয়োদা সিটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন সেমিনার’-এ, যেখানে নিজে উপস্থিত ছিলেন ড. ইউনূস। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া জাপানি ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১ লাখ কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনার কথা জানান, যা জাপানের শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
৩০ মে শুক্রবার ড. ইউনূস অংশ নেন নিক্কেই ফোরাম: ‘ফিউচার অব এশিয়া’ নামক এক মর্যাদাপূর্ণ সম্মেলনে, যেখানে তিনি মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক ব্যবসা, যুবসম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণা ও চিন্তাভাবনা। নিক্কেই ফোরাম এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে পরিচিত।
ফোরামের ফাঁকে ড. ইউনূস মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মাদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশকে আসিয়ান (ASEAN) জোটের সদস্যপদ দেওয়ার ব্যাপারে মাহাথিরের সমর্থন কামনা করেন। জানা গেছে, এই বিষয়টি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য এবং আঞ্চলিক সংযুক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সফরের এক বিশেষ মুহূর্তে, জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয় ড. ইউনূসকে “সমাজিক উদ্ভাবন ও বৈশ্বিক উন্নয়নে অবদানের জন্য” সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এটি ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক অবদানের একটি প্রতীকী স্বীকৃতি, যেখানে শান্তি, দারিদ্র্য বিমোচন ও যুবসম্ভাবনা উন্নয়নে তাঁর কাজকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হয়।
এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক কেবল আরও দৃঢ় হয়েছে তা নয়, একইসঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ, শ্রমবাজার, অবকাঠামো এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই অর্জন আগামী দিনে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার এই সফর কূটনৈতিক অর্জন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথনকশা রচনা করল—যা শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবায়নের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ