
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতি আরও একধাপ বেড়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিমান হামলার মধ্য দিয়ে। রোববার (২২ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, ইরানের তিনটি অত্যন্ত সংবেদনশীল পারমাণবিক স্থাপনায় সফলভাবে সামরিক হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ছয়টি ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ট্রাম্প এই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের "চমৎকার সামরিক সাফল্য" হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতিতে এই হামলার প্রতিক্রিয়া যেমন জোরালো, তেমনি এর সামরিক তাৎপর্যও অসাধারণ। কারণ ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান—এই তিনটি স্থাপনাই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্রে অবস্থিত, এবং দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক নজরদারির আওতায় ছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফক্স নিউজের জনপ্রিয় উপস্থাপক শন হ্যানিটির সঙ্গে ফোনালাপে এই হামলার তথ্য জানান। হ্যানিটি পরে এই বিষয়টি ‘টাইমস অব ইসরায়েল’কে নিশ্চিত করেন। ট্রাম্প বলেন, “আমরা ফোরদোর মতো একটি চরম সুরক্ষিত স্থানে ছয়টি বাঙ্কার বাস্টার বোমা ব্যবহার করেছি। নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানেও হামলা চালানো হয়েছে, এবং সব বিমান এখন ইরানের আকাশসীমার বাইরে।”
ট্রাম্প তার নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করে লেখেন, “আমরা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় অত্যন্ত সফলভাবে হামলা করেছি। সমস্ত লক্ষ্যবস্তু নির্ভুলভাবে ধ্বংস হয়েছে। ফোরদো এখন আর আগের মতো নেই।”
তিনি আরও বলেন, “এই হামলা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংসের একটি বড় ধাপ এবং সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জড়িত একটি দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের অংশ।”
বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনাটি ইরানের কোম প্রদেশের একটি পাহাড়ি এলাকার নিচে নির্মিত। এটি এতটাই নিরাপদভাবে নির্মিত যে সাধারণ বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ‘বাঙ্কার বাস্টার’ নামে পরিচিত গভীর ভূগর্ভস্থ বোমা ব্যবহার করে, যা শক্ত পাহাড় বা সুরক্ষিত কংক্রিটের ভেতরে ঢুকে বিস্ফোরিত হয়।
কোম প্রদেশের প্রাদেশিক ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট হেডকোয়ার্টারের মুখপাত্র মোর্তেজা হায়দারি বলেন, “কয়েক ঘণ্টা আগে কোমের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছিল। শত্রু লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত হওয়ার পর ফোরদোর কিছু অংশ শত্রু বিমানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা দেশটির রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থার এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্রের যেসব স্থাপনায় হামলার দাবি করা হয়েছে, সেখানে এমন কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ নেই যা পারমাণবিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।”
তবে একইসঙ্গে ইরানের আধা-সরকারি তাসনিম বার্তা সংস্থা স্বীকার করেছে যে, ফোরদোর কিছু অংশ বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, তেহরান একদিকে হামলার বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে, আবার অন্যদিকে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক উদ্বেগ এড়াতে চাচ্ছে।
ট্রাম্প একটি ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স অ্যাকাউন্টের একটি পোস্ট শেয়ার করেন যেখানে বলা হয়েছে, “শক্তিশালীভাবে সুরক্ষিত ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনাটি নাই হয়ে গেছে।” যদিও এর সত্যতা যাচাই করা যায়নি, তবু এই বক্তব্য ফোরদোর ধ্বংসপ্রাপ্তির ধারণাকে আরও জোরদার করে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি এই দাবি সত্য হয়, তবে এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে এক ভয়াবহ ধাক্কা। কারণ ফোরদো এমন একটি কেন্দ্র, যেটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর নথিতেও উল্লেখযোগ্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এই অভিযানের পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। রাশিয়া ও চীন এরই মধ্যে এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং একে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ উসকে দেওয়ার মতো উসকানিমূলক কাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “আমরা দুই পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাই। যুদ্ধ হলে ক্ষতি হবে সবার।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা বলেছে, পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি হামলা ‘মারাত্মক ঝুঁকি’ তৈরি করতে পারে যা শুধু একটি দেশ নয়, গোটা অঞ্চলকে প্রভাবিত করতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, এই হামলা কি একটি বিচ্ছিন্ন সামরিক অভিযান, নাকি এটি একটি ধারাবাহিক হামলার সূচনা? ট্রাম্পের বক্তব্য অনুসারে, আরও লক্ষ্যবস্তু প্রস্তুত রয়েছে, এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সেখানে হামলার সম্ভাবনাও রয়েছে।
তবে এটাও স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র কেবল সামরিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও ইরানকে কোণঠাসা করতে চাইছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহলের নজর ঘুরিয়ে তেহরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা বা রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগেরও প্রস্তুতি চলছে।
ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে যুক্তরাষ্ট্রের এই সমন্বিত হামলা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনাই নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামোতেও এক বড় ধাক্কা। পারমাণবিক অস্ত্র ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের নামে যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযান অনেকের চোখে ‘সাবধানবার্তা’, আবার অনেকের কাছে এটি একটি উদ্বেগজনক ‘অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া’।
ইরান এখন হয়তো কৌশলগত নীরবতায় আছে, তবে তাদের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হতে পারে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। বিশ্ববাসী এখন তাকিয়ে আছে, পরবর্তী ধাপে শান্তি আসবে, নাকি এই আগুন আরও ছড়িয়ে পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ