
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এক নতুন অধ্যায় সূচিত হলো চীনের উদ্যোগে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে গঠিত একটি ত্রিপক্ষীয় জোটের মাধ্যমে। আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন এবং পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে এই জোট গঠনের ঘোষণা আসে গত ১৯ জুন চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে। বৈঠকে তিন দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং বৈঠক শেষে এক প্রতীকী মুহূর্তে একে অপরের হাতে হাত রেখে ত্রিপাক্ষিক ঐক্যের বার্তা দেন।
এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পক্ষে ভাইস ফরেন মিনিস্টার সান উইডং, বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী এবং পাকিস্তানের পক্ষে অতিরিক্ত সচিব (এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল) ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকের শুরুতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনায় যুক্ত হন।
বৈঠকে আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল—ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে তিন দেশের মধ্যে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক সমন্বয় নিশ্চিত করা। চীনের ভাইস মিনিস্টার সান উইডং বলেন, “চীন তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সৎ প্রতিবেশী এবং কার্যকর অংশীদার। আমরা উচ্চমানের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর অংশীদার হিসেবেও একযোগে কাজ করছি।”
তিনি আরও বলেন, “চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, তিনটি দেশই গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের পথে রয়েছে। এই লক্ষ্যে আমরা শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ চাই, যাতে করে আমাদের জনগণ উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারে।”
বৈঠকে তিন দেশ নিজেদের সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে বলেন, তারা পরস্পরের ভালো বন্ধু, ভালো প্রতিবেশী এবং ভালো অংশীদার। সেই ভিত্তিতে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখভাল করবে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ত্রিপক্ষীয় এই জোট অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবিকায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে কাজ করবে। এর আওতায় যেসব খাতে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: শিল্প ও বাণিজ্য, মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ও ব্লু ইকোনমি, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, কৃষি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও যুব উন্নয়ন এবং থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও নীতিগত গবেষণার সমন্বয়।
এছাড়াও বৈঠকে স্পষ্ট করা হয়, তিন দেশ উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামোতে বিশ্বাসী এবং বহুপক্ষীয়তাকে গুরুত্ব দেয়।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি চীনের ভাইস ফরেন মিনিস্টার সান উইডং বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে পৃথক এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)–এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এবং চলমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিয়ে উভয়পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে আরও যৌথ উদ্যোগের প্রত্যাশা করে।
এই জোটকে অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের নতুন কৌশলগত অগ্রযাত্রা হিসেবে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত বলয়ের বাইরে চীন এই অঞ্চলে বিকল্প এক সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তুলছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান—দুই দেশকে সঙ্গে নিয়ে চীন এখন দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরেই এক ধরণের ভূ-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করতে চাইছে।
ঢাকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. মাহমুদ হাসান বলেন, “এই জোট শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক সমন্বয় এবং পররাষ্ট্রনীতির এক নতুন বাস্তবতা নির্দেশ করছে। বাংলাদেশের জন্য এটি যেমন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন, তেমনি কৌশলগত চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে, বিশেষ করে ভারত ও পশ্চিমা জোটের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নে।”
চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এই ত্রিপক্ষীয় জোট দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে বহুপক্ষীয় ভারসাম্য রক্ষায় এক কৌশলগত ভূমিকা পালন করতে পারে। এখন দেখার বিষয়, ওয়ার্কিং কমিটির মাধ্যমে এই উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়িত হয় এবং এই সহযোগিতা ভবিষ্যতে কতটা টেকসই হয়।
ত্রিপক্ষীয় এই মঞ্চ কেবল তিন দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের জন্যই এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক মহল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ