
ছবি: সংগৃহীত
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে সম্মত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার তিন গুরুত্বপূর্ণ দেশ—বাংলাদেশ, চীন এবং পাকিস্তান। পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহায়তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে এই তিন দেশ একটি ত্রিপক্ষীয় প্ল্যাটফর্ম গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে, যা এই উদ্যোগের কাঠামো ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে কাজ করবে।
চীন-বাংলাদেশ-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী/পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার (২০ জুন) তাদের ওয়েবসাইটে এই বৈঠকের বিবরণ প্রকাশ করে।
বৈঠকে চীনের পক্ষে অংশ নেন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েইডং। বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিক। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী, এবং ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ।
ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। তারা সুদৃঢ় আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে ‘সুপ্রতিবেশীসুলভতা, সমতা ও পারস্পরিক বিশ্বাস, উন্মুক্ততা ও অন্তর্ভুক্তি, সাধারণ উন্নয়ন এবং উইন-উইন সহযোগিতা’ নীতির ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান তিন দেশই একমত হয় যে, কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণেই নয়, বরং বিভিন্ন খাতভিত্তিক প্রযুক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও গবেষণাধর্মী সহযোগিতাও এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।
ত্রিপক্ষীয় এই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে সহযোগিতার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। শিল্প ও উৎপাদন, বাণিজ্য, সমুদ্র বিষয়ক কার্যক্রম (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স), জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, কৃষি উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গবেষণা ও নীতিনির্ধারণে থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ভূমিকা, স্বাস্থ্যখাত, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও তরুণ সমাজ—এই সকল খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এই সকল ক্ষেত্রের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ, কাজের পরিধি নিরুপণ এবং বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধানের জন্য একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। এই গ্রুপ নিয়মিতভাবে সভা করে প্রকল্প নির্ধারণ, প্রয়োগ ও মূল্যায়ন করবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া তিন দেশ জোর দিয়ে উল্লেখ করে, এই ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা কোনোভাবেই কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে তৈরি হয়নি। এটি বহুপাক্ষিকতা এবং উন্মুক্ত আঞ্চলিকতার নীতিমালার আলোকে একটি সার্বিক সহযোগিতামূলক কাঠামো গড়ার প্রয়াস। এর মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক আন্তঃনির্ভরশীলতার ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে বলে অংশগ্রহণকারীরা মত দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয়, বরং দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় একটি নতুন কৌশলগত সমীকরণের ইঙ্গিত বহন করে। যেখানে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) পরিসর আরও সম্প্রসারিত করতে চায়, সেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (CPEC) এবং বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্কের সংযোগস্থলে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যদি সমুদ্রবন্দর, রেলপথ ও শিল্পজোন উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে এর সুফল দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হবে।
এই ত্রিপক্ষীয় প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে একদিকে যেমন উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বিনিময় এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা সহজতর হবে, অন্যদিকে সমগ্র অঞ্চলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি উৎপাদনশীলতা, যুব উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে।
এই প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ হিসেবে, খুব শিগগিরই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা, সময়সূচি ও প্রকল্প নির্বাচনের বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হবে। এই কর্মপন্থা বাস্তবায়নের জন্য তিন দেশই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সহায়তার একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হবে, যা ভবিষ্যতের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ