
ছবি: সংগৃহীত
নাজমুল হোসেন শান্তর ব্যাটে আবারও ইতিহাস গড়া এক মুহূর্ত। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি পূর্ণ করে তিনি নাম লিখিয়ে ফেলেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের এক অনন্য তালিকায়, যেখানে জায়গা পেয়েছেন ক্রিকেটের কিংবদন্তি ডন ব্র্যাডম্যান, ইনজামাম-উল-হক, অ্যালান বোর্ডার, রিকি পন্টিং, বিরাট কোহলির মতো তারকারা। এই কীর্তি তাকে শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসেও বিশেষ এক মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে বৃষ্টির কারণে খেলা কিছু সময় বন্ধ থাকায় শান্তর সেঞ্চুরি পথ যেন দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। তবে সেই অপেক্ষা যত দীর্ঘই হোক, শান্তর মনোবল ছিল অটুট। খেলা পুনরায় শুরু হলে শান্ত ধৈর্য্য, শৃঙ্খলা ও দারুণ ব্যাটিং দক্ষতায় সেঞ্চুরি তুলে নেন। ৮৫তম ওভারে থারিন্দু রত্নায়েকের বলে প্যাডেল সুইপ করে ১৯০তম বলে শতরানের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ পূর্ণ করেন তিনি।
এই ইনিংসে শতরান পূর্ণ করতে শান্ত মেরেছেন ৯টি চার। তার ইনিংস ছিল পুরোপুরি এক মনঃসংযোগ, নিয়ন্ত্রণ ও পরিণত ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি। প্রথম ইনিংসে ১৪৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও শতক করে তিনি এই ম্যাচে জোড়া সেঞ্চুরি করেন। এটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বিশেষ একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে।
এর মধ্য দিয়ে শান্ত হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম অধিনায়ক যিনি কোনো ম্যাচে জোড়া সেঞ্চুরির কীর্তি গড়লেন। এর আগে ব্যাটার হিসেবে এমন কীর্তি গড়েছিলেন কেবল দুইজন বাংলাদেশি—মুমিনুল হক ও শান্ত নিজেই। ২০১৮ সালে মুমিনুল হক করেছিলেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই, আর শান্ত করেছিলেন ২০২৩ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে এমন কীর্তি এবারই প্রথম।
এটি শান্তর টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একইসঙ্গে এটি আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে, অধিনায়কের দায়িত্ব পেলেও তার ব্যাটিংয়ে কোনো শৈথিল্য আসেনি—বরং আরও পরিণত হয়েছেন তিনি। কৌশলগত, মানসিক এবং ক্রীড়াগত দিক থেকে তিনি নিজেকে আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট ম্যাচের দুই ইনিংসেই শতরান করার কীর্তি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিরল এক অর্জন। এখন পর্যন্ত এই কীর্তি গড়েছেন মাত্র ১৬ জন অধিনায়ক। সেই তালিকায় রয়েছেন ডন ব্র্যাডম্যান, অ্যালান বোর্ডার, রিকি পন্টিং, ইনজামাম-উল-হক, গ্রায়েম স্মিথ, বিরাট কোহলির মতো বিশ্ব ক্রিকেটের গর্বিত নামগুলো। সেই তালিকাতেই এবার যুক্ত হলো বাংলাদেশের নাজমুল হোসেন শান্তর নাম।
শান্তর এই কীর্তি কেবল ব্যাটিং পারফরম্যান্স নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের মানসিক ও কৌশলগত পরিপক্বতারও প্রতীক হয়ে উঠেছে। তিনি যেমন ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি চাপের মুহূর্তে দলের জন্য একটি বড় ইনিংস গড়ে দলের ভিত মজবুত করেছেন।
এই ম্যাচে শান্তর সেঞ্চুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় রচিত হলেও, এর পেছনে আছে কিছু পুরনো ইতিহাসও। এর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে দুইজন অধিনায়ক—২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের ব্রেন্ডন টেলর এবং ২০২৪ সালে এই শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা একইভাবে জোড়া সেঞ্চুরি করেছিলেন। বিশেষ করে ডি সিলভার জোড়া সেঞ্চুরি বাংলাদেশিদের মনে একরাশ হতাশা সৃষ্টি করেছিল। এবার সেই হতাশার জবাব দিলেন শান্ত নিজের ব্যাটে।
শুধু ব্যাট হাতে নয়, পুরো ম্যাচ জুড়েই শান্তর নেতৃত্ব ছিল প্রশংসনীয়। মাঠে তার কৌশলগত সিদ্ধান্ত, ফিল্ডিং সাজানো, বোলারদের রোটেশন এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব—সবকিছুই ম্যাচের গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলছেন, শান্তর এই ব্যাটিং ও নেতৃত্ব বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ক্রিকেট বিশ্বে এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যা কেবল রানের হিসেবে নয়, বরং ক্রীড়ানুরাগীদের আবেগ, গর্ব এবং আত্মপরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। নাজমুল হোসেন শান্তর এই ইনিংস তেমনই এক মুহূর্ত। একটি সেঞ্চুরি যে শুধু পরিসংখ্যান নয়, তা শান্ত আবারও প্রমাণ করলেন। তার জোড়া সেঞ্চুরির মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে যোগ হলো এক নতুন অধ্যায়, যা অনেক বছর ধরে আলোচনায় থাকবে, অনুপ্রেরণার উৎস হবে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ