
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। প্রায় তিন দশক ধরে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতদিন শুধুমাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার সেসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর গবেষণা, বিশেষ করে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর পথ উন্মুক্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সোয়াস (School of Oriental and African Studies), ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন যৌথভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ পিএইচডি প্রোগ্রামের ঘোষণা দিয়েছে। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির এক নতুন অধ্যায় সূচিত হলো, যা দেশের গবেষণাক্ষেত্রে বহুল কাঙ্ক্ষিত এক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
১৯৯২ সালে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার বৈচিত্র্য ও চাহিদা পূরণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাসের মাধ্যমে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও গবেষণার সর্বোচ্চ পর্যায়—পিএইচডি—চালুর অনুমোদন পায়নি কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অবশেষে, সেই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে এবার এই স্তরের শিক্ষায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
২০২৫ সালের ১৬ জুন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের যৌথ উদ্যোগে ‘Political Economy of Development’ শিরোনামে একটি পূর্ণাঙ্গ পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু হয়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয় দু’টি ক্যাম্পাসে—লন্ডনে সোয়াস-এর ক্যাম্পাসে ও ঢাকায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মেরুল বাড্ডা ক্যাম্পাসে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সোয়াস-এর ভিসি প্রফেসর অ্যাডাম হাবিব, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন তামারা হাসান আবেদ এবং যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার জানান, “উন্নয়ন অধ্যয়নে আমাদের দেশীয় বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে যেভাবে গবেষণার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, এটি গবেষণাকে আরও কার্যকর ও বাংলাদেশভিত্তিক করতে সহায়তা করবে।”
এই পিএইচডি প্রোগ্রামে গবেষণার বিষয় নির্ধারিত হয়েছে উন্নয়ন অধ্যয়নের প্রেক্ষাপটে। এর মধ্যে থাকছে—
কার্যকর দুর্নীতি দমন নীতিমালা
শাসনব্যবস্থার সংস্কার
নাগরিক প্রতিক্রিয়া ও অভিযোগ ব্যবস্থাপনা
সরকারি খাতের জবাবদিহিতা
অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাত বিশ্লেষণ
নারী অধিকার ও লিঙ্গ সমতা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
শ্রম অধিকার, সামাজিক আন্দোলন এবং সরকারি সেবার রাজনীতি
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ইতোমধ্যে পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. এসএমএ ফয়েজ জানিয়েছেন, “আমরা গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। পিএইচডি একটি ব্যয়বহুল প্রোগ্রাম হওয়ায় তা চালু করা এতদিন সম্ভব হয়নি। তবে এখন আমরা সেই বাধা কাটিয়ে উন্নত গবেষণার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করেছে, আন্তর্জাতিক র্যাংকিং-এ উন্নতি করেছে, তাদেরই ধাপে ধাপে পিএইচডি চালুর অনুমোদন দেওয়া হবে।”
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে একটি পরীক্ষামূলক গাইডলাইন অনুসরণ করার শর্তে। গাইডলাইনে বলা হয়েছে, গবেষণায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক কো-সুপারভাইজার থাকতে হবে এবং গবেষণার একটি অংশ বাংলাদেশে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে সম্পন্ন করতে হবে।
পিএইচডি প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রিধারী হওয়া, গবেষণাগার, তথ্যভান্ডার, পাবলিকেশনের সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণার মান বজায় রাখার সক্ষমতা।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং সোয়াস-এর ইকোনমিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
ইউজিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, “পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য বয়স কোনো বাধা নয়। এটি আগ্রহ ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করবে। গবেষণায় আগ্রহী যে কেউ, যার প্রকাশনা রয়েছে, যিনি মাস্টার্সে ন্যূনতম গ্রেড অর্জন করেছেন, তিনি পিএইচডি করতে পারবেন।”
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীকে রিসার্চ প্রপোজাল জমা দিতে হবে এবং তা পূর্ণকালীনভাবে পরিচালনার প্রস্তুতি থাকতে হবে। যদি কেউ চাকরিজীবী হন, তাহলে ছুটিতে থাকতে হবে কিংবা গবেষণাকাজ খণ্ডকালীনভাবে চালাতে হবে। যদিও এ বিষয়গুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং নীতিমালায় চূড়ান্তভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
বর্তমানে ব্র্যাক ছাড়াও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আইইউবি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-সহ আরও কয়েকটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিষয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক আবদুল হান্নান জানান, “আমাদের প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই পিএইচডি চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা ইউজিসির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি।”
বাংলাদেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতে এটি একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। শুধু উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার এই প্রয়াস ভবিষ্যতে দেশের জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলেই বিশ্বাস বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ