
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক। চীনের কুনমিং শহরে আয়োজিত ‘নবম চায়না–সাউথ এশিয়ান এক্সপো’ এবং ‘ষষ্ঠ চায়না–সাউথ এশিয়া কো-অপারেশন ফোরাম’-এর সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বলয়ের সম্ভাবনার ইঙ্গিত মিলেছে, যা ইতোমধ্যে ভারতের জন্য কূটনৈতিকভাবে একটি বড় বার্তা হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।
এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েইডং, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী এবং পাকিস্তানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ এতে যুক্ত হন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে।
যদিও বৈঠকটিকে ‘অনানুষ্ঠানিক’ বলা হয়েছে, তবু অংশগ্রহণকারী তিন দেশই এর পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ইঙ্গিত মিলেছে যে, সহযোগিতা শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং এর বাস্তবায়নেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
যৌথ বিবৃতি ও ভারতের প্রতি বার্তা
বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, তিন দেশ ‘প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব, সমতা, পারস্পরিক আস্থা, উন্মুক্ততা ও অন্তর্ভুক্তির ভিত্তিতে’ আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একযোগে তারা বহুপক্ষীয়তা এবং উন্মুক্ত আঞ্চলিকতার পক্ষেও নিজেদের অবস্থান জানায়।
যদিও তারা দাবি করেছে—এই উদ্যোগ ‘কোনো তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে নয়’, বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। কারণ, বর্তমান সময়ে ভারতের সঙ্গে এই তিন দেশেরই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে রয়েছে টানাপোড়েন। বিশেষ করে সীমান্ত ইস্যু, পানিবণ্টন, কাশ্মীর প্রসঙ্গ এবং আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভারত-চীন ও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উত্তপ্ত। বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্প্রতি রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভারতের সম্পর্কের রসায়নে পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ মনে করেন, “এই ত্রিদেশীয় আলাপচারিতা এখনো পরিণত হয়নি, কিন্তু এর মধ্যেই স্পষ্ট হচ্ছে এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং কৌশলগত প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রতি একটি ইঙ্গিতমূলক বার্তা।” তার মতে, বিসিআইএম করিডোর ও সার্কের মতো আঞ্চলিক উদ্যোগ ভারতের অনাগ্রহে থমকে আছে—এই প্রেক্ষাপটে এই নতুন কাঠামো ভারতের আগ্রহকে পরখ করার একটি কৌশল হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম রানা বলেন, “এই ত্রিপক্ষীয় কাঠামো আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি নতুন বলয়ের উত্থানের ইঙ্গিত বহন করছে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা হিসেবে উপস্থাপিত, কিন্তু চীন অতীতে যেভাবে অর্থনৈতিক উদ্যোগকে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম করেছে, তাতে এ উদ্যোগও সেই পথেই যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তানের জন্য এটি একটি কূটনৈতিক পুনরুত্থানের সুযোগ, আর বাংলাদেশের জন্য এটি উন্নয়ন সহযোগিতা এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব গভীর করার সম্ভাবনা। তবে ভারতের জন্য এটি নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের সৃষ্টি করতে পারে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, “এই ধরনের কৌশলগত প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার আগে অবশ্যই গভীরভাবে হোমওয়ার্ক করা দরকার। কারণ, ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া আসবে—এটা অনুমানযোগ্য।”
তার মতে, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে ভারত তা ইতিবাচকভাবে দেখবে না। এ কারণে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
চীনের অর্থনৈতিক ভূমিকা এবং কৌশলগত প্রভাব
চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ চীন থেকে ৮.৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যেখানে রপ্তানি মাত্র ৪৬১ মিলিয়ন ডলার। এই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ করছে—যেমন কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ ও মেট্রোরেল প্রকল্পে চীনা ঋণ ও কারিগরি সহায়তা রয়েছে।
পাশাপাশি সামরিক সহযোগিতাও বাড়ছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, চীন বাংলাদেশে একটি সামরিক ‘রেডার স্থাপনা’র প্রস্তাব দিয়েছে—যা ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এতে বোঝা যায়, চীন কৌশলগতভাবেও বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চাইছে।
পাকিস্তান: কোণঠাসা অবস্থা থেকে কূটনৈতিক পুনরুদ্ধার?
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপে থাকা পাকিস্তানের জন্য এই বৈঠকটি কূটনৈতিকভাবে বড় সুযোগ। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামাবাদ ও বেইজিং ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে আফগানিস্তান নিয়েও। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে পাকিস্তান চায় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে।
বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এখনো নগণ্য (১০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে), কিন্তু ভিসা নীতি সহজকরণ, কূটনৈতিক সংলাপ পুনরায় শুরু এবং ‘সীমিত বাণিজ্য’ বাড়ানোর লক্ষ্যে উভয় দেশ একমত হয়েছে।
ভারত: প্রতিক্রিয়া ও আশঙ্কা
এই বৈঠকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করলেও ভারতের কূটনৈতিক মহলে এটি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব সব সময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে চীন ও পাকিস্তানের জোট গঠনে। ভারতের কৌশলগত মিত্রতা এখনো প্রধানত কোয়াড, বিমস্টেক ও আইওআরএ কেন্দ্রিক, যেখানে চীনের কোনো উপস্থিতি নেই।
ভারতের কূটনীতিকরা ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে এই উদ্যোগকে চীনের একটি স্ট্র্যাটেজিক ‘ইনফ্লুয়েন্স প্রজেকশন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এমনকি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার নিরাপত্তা জোরদারে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা দূরত্বে গেছে। তবে ভারত এখনো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। গত অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যেখানে রপ্তানি মাত্র ১.৫৭ বিলিয়ন ডলারে সীমিত।
এই টানাপোড়েনপূর্ণ বাস্তবতায় ত্রিপক্ষীয় জোট গঠন ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে স্পষ্ট বার্তা বয়ে আনে। ভারতের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা একে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টার অংশ হিসেবে দেখছেন।
চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় বৈঠককে আপাতদৃষ্টিতে ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা’র প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা গেলেও এর কৌশলগত ব্যাখ্যা আরও গভীর। বিশেষ করে যখন ভারত এই জোটের বাইরে এবং বৈঠকটি এমন এক সময়ে আয়োজিত হয়, যখন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নতুন রূপ নিচ্ছে—তখন এর বার্তা অনেক স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের জন্য এটি একদিকে উন্নয়ন সহযোগিতার নতুন দরজা খুলে দিতে পারে, অন্যদিকে আঞ্চলিক কূটনৈতিক ভারসাম্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো ধরনের কৌশলগত প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার আগে বাংলাদেশকে অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে হবে—কারণ, এই বৈঠকের পর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি আর আগের মতো থাকবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ